আপডেট : ২৮ July ২০১৯
সিলেট-আখাউড়া পর্যন্ত ১৭৯ কিলোমিটারের রেলপথের পুরোটাই ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন ট্রেন চলাচল করছে। এমন কি ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ১৩ ডেড স্টপ। এমন ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথে ট্রেন ভ্রমণে আগ্রহ হারাচ্ছের যাত্রীরা। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, গত ২৩ জুন কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়ায় ঢাকাগামী আন্ত:নগর ট্রেন উপবন দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া স্থানও এখনও পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি। এ ঘটনায় রেলওয়ের ২৮ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৭ জুলাই গরুর সাথে ধাক্কায় জয়ন্তিকার ইঞ্জিন বিকল হওয়া, ১৭ জুলাই কালনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছালে ছিড়ে যায় ব্রেকের তার। প্রায় ১ ঘন্টা সময় ক্ষেপণ শেষে বেশি করে তার লাগিয়ে তোড়াতালি দিয়ে সিলেটে পৌছে ট্রেনটি। ১৯ জুলাই দুপুরে কুলাউড়া আউটার সিগন্যালের কাছে লাইনচ্যুত হয় জয়ন্তিকার একটি বগি। একই স্থানে পরদিন ২০ জুলাই সকালে আন্ত:নগর কালনি ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। রেলওয়ের একাধিক সূত্র জানায়, সিলেট-আখাউড়া রুটের রেলসেতু ও কালভার্টগুলোর অর্ধশত বছরের পুরনো কাঠের স্লি¬পারের অধিকাংশ বিনষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি লাইনের ক্লিপ চুরি হওয়া ও পাথর সরে যাওয়ার কারণেই দীর্ঘদিন থেকেই ‘মরণফাঁদে’ পরিণত হয়েছে রেলপথ। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ বগি ও ইঞ্জিন তো আছেই। খোদ রেল বিভাগই স্বীকার করে এ ভয়াবহ চিত্রের কথা। এছাড়া রেললাইনের ক্লিপ-হুক উঠে যাওয়া, সেতু-কালভার্ট সংস্কারের অভাবে ও রেলসেতুর কাঠের স্লি-পারগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ন হয়ে উঠেছে এ রেলপথটি। এছাড়া রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ 'মোটর-ট্রোলি' করে লাইন চেকে গাফিলতির ফলে নানা ত্রুটি অজানা থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয় প্রতিনিয়িত। রেলসেতুর স্লিপার আটকাতে বাঁশ ব্যবহার করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৭০ থেকে ১০০ বছরের কিংবা তারও বেশি পুরনো সেতুগুলো শুধু ঝুঁকিপূর্নই নয়, চরম আতঙ্কেরও বটে। এছাড়া স্টিল কিংবা লোহার ব্রিজগুলো আরো ঝুঁকিপূর্ন। সেতুগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশেরই মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের মতে, নির্মাণের ৫০-৫৫ বছর পর সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। রেলওয়ে সূত্রে আরো জানা যায়, সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে ১৭৮ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। ১৭৬ কিলোমিটারের ঢাকা-সিলেট রেলপথটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি। ঢাকা থেকে ভৈরব পর্যন্ত ডাবল লাইন স্থাপন করা হলেও ভৈরব থেকে সিলেট পর্যন্ত রয়েছে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। দীর্ঘ এ পথে ছোট-বড় ২৫০টির বেশি সেতু রয়েছে। সর্বনিম্ন তিন ফুট থেকে ৩০০ ফুট দীর্ঘ পর্যন্ত সেতুগুলো ৬০-৭০ বছর আগে নির্মিত। প্রতিদিন এই রেলপথে ৬ জোড়া আন্ত:নগর ট্রেন এবং ৭টি লোকাল ট্রেনসহ কয়েকটি পণ্যবাহী ট্রেনও চলাচল করে। সিলেট-আখাউড়া রেলপথের ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩টি সেতু যেন মরণফাঁদ। রেলওয়ের তালিকায় থাকা এই ১৩টি সেতুর ওপর ট্রেন পারাপারে ‘ডেড স্টপ’ (সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, এরপর পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে) ঘোষণা করা হয়েছে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আটটি এবং মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি সেতু ‘ডেড স্টপ’ এর আওতাধীন। রেলওয়ের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা যায়, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের ঝুঁঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে শমসেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯নং সেতু এবং মনতলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। সেতু সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এগুলো সংস্কার হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তথ্য মতে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনি এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা এবং সিলেট-চট্টগ্রাম পথে ভ্রমণ করেন। রেলপথে যারা ভ্রমণ করেন তাদের বেশির ভাগই রেলকে বেছে নেন নিরাপদ যাত্রার মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু বারবার যান্ত্রিক ত্রুটি ও দুর্ঘটনার কারণে এই রেলপথে চলাচল ঝুঁকিপূর্ন হয়ে পড়েছে। ট্রেনে যাত্রীর চাপ বাড়ছে জানিয়ে কুলাউড়া স্টেশন মাস্টার মো. মুহিব উদ্দিন জানান, সবাই মনে করে স্টেশন মাষ্টারই সব। প্রকৃত পক্ষে বেশ কয়েকটি প্রকৌশল বিভাগের ক্লিয়ারেন্স পেয়েই আমরা ট্রেন পরিচালনা করে থাকি। এখানে স্টেশন মাস্টারের করার কিছু নেই। তবে সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে আগে ট্রেন চলতো ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। বর্তমানে সেই গতি অর্ধেকে ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এ ব্যাপারে এসএসআই সিগন্যাল মো. হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী দুর্ঘটনার সম্পর্কে জানান, কুলাউড়া রেলস্টেশন এলাকায় টানা দু’দিন ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়া প্রসঙ্গে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে হিলব্লক ছুটে দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে। শুধু তাই নয় রেললাইনে নেই পর্যাপ্ত পাথর। সেতুগুলো ঝঁকিপূর্ন। সমস্যার তুলনায় দুর্ঘটনা কম হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। অতিরিক্ত উদ্ধতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পথ) আশরাফুল আলম জানান- আমি এখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। খুব দ্রুত গতিতে এই রেলপথের মেরামত কাজ চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনার ব্যাপারে ২২ জুলাই আখাউড়া-কুলাউড়া, সিলেট সেকশন পরিদর্শণ করেন রেলওয়ের জিএম (পূর্বাঞ্চল) মো. নাসির উদ্দিন আহমদ। তিনি জানান, আমি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয়র নতুন দায়িত্বে এসেছি। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটি ভালো বলতে পারবে। আমি শুধু সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়ার রেলপথ পরিদর্শনে এসেছি। যেসব স্থানের রেলপথ ও সেতুতে ত্রুটি রয়েছে সেগুলো দ্রুত মেরামত করা হবে। রেল দুর্ঘটনায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি আরো বলেন, ‘সিলেট আখাউড়া রেলপথটি নতুন করে ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প ইতোমধ্যে পাস করা হয়েছে। তাছাড়া আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ রুটের সবকটি আন্ত:নগর ট্রেনের বিদেশ থেকে আমদানীকৃত নতুন বগি সংযোজন করা হবে।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১