আপডেট : ২৫ June ২০১৯
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি কথা আছে, ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’। সেই রাজনীতি যদি অর্থনীতির কল্যাণে পরিচালিত না হয়, তাহলে সুষম অর্থনীতি কখনোই আশা করা যাবে না। আমাদের ইতিহাস অবশ্য বলে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ। প্রথম বাজেটসহ তিনি মোট তিনবার (১৯৭২-৭৩, ১৯৭৩-৭৪ ও ১৯৭৪-৭৫) বাজেট পেশ করেন। ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আজিজুর রহমান মল্লিক। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান টানা তিনবার (১৯৭৬-৭৭, ১৯৭৭-৭৮ ও ১৯৭৮-৭৯) বাজেট পেশ করেন। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এমএন হুদা বাজেট পেশ করেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে এম সাইফুর রহমান ১৯৮০-৮১ ও ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে দুবার এবং ১৯৯১-৯২, ১৯৯২-৯৩, ১৯৯৩-৯৪, ১৯৯৪-৯৫, ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে পাঁচবার এবং ২০০২-০৩, ২০০৩-০৪, ২০০৪-০৫, ২০০৫-০৬, ২০০৬-০৭ পর্যন্ত আরো পাঁচবারসহ সর্বমোট ১২ বার বাজেট পেশ করেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দুবার, ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ বারসহ সর্বমোট ১২ বার বাজেট পেশ করেন। ১৯৮৪-৮৫, ১৯৮৫-৮৬, ১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৭-৮৮ এই চার অর্থবছর বাজেট দেন অর্থমন্ত্রী এম সায়েদুজ্জামান। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান মেজর জেনারেল এমএ মুনিম। তিনি দুবার (১৯৮৮-৮৯ ও ১৯৯০-৯১) বাজেট পেশ করেন। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ওয়াহিদুল হক। তিনি ওই অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে শাহ্ এএমএস কিবরিয়া ১৯৯৬-৯৭, ১৯৯৭-৯৮, ১৯৯৮-৯৯, ১৯৯৯-২০০০, ২০০০-০১ ও ২০০১-০২ অর্থবছরে মোট ছয়বার বাজেট পেশ করেন। এছাড়া ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ এই দুই অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ... স্বাধীনতা তুমি’র কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতার মতো করেই যখন দেশ চলছে, তখন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদের মতো সর্বোচ্চ আইনি স্থানে বসে বলেছেন, ‘রাজহাঁস থেকে পালক উঠাও যতটা সম্ভব ততটা, তবে সাবধান— রাজহাঁসটি যেন কোনোভাবেই ব্যথা না পায়।’ ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী জিন ব্যাপটিস্ট কলবার্টের এই উক্তিটি উচ্চারণ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ক্রমেই সমস্যার জাল বুনছেন বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে। কেননা এ নীতি অনুসরণ করেই এক কোটি লোককে ‘করজাল’-এর আওতায় আনার ঘোষণা দিয়ে বাজেট (২০১৯-২০) প্রস্তাব পেশ করেন তিনি। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এতে তিনি সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন রকম আশার কথা উচ্চারণ সাপেক্ষে জাতীয় সংসদে আ হ ম মুস্তফা কামাল এ বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনের সময় বলেন, আমাদের সরকারের কর রাজস্ব আহরণের মূলনীতি হচ্ছে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে। তবে সেটা করহার বাড়িয়ে নয়; বরং সেটা করতে হবে করের আওতা বিস্তৃত করে। পাশাপাশি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো আমরা কোনোভাবেই কোনো করদাতার ওপর বোঝা হিসেবে কর চাপিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে। সেক্ষেত্রে জিন ব্যাপটিস্টে কলবার্টের নীতি অনুসরণ করা হবে। কিন্তু এই নীতি তৈরি করবে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ। গড়ে তুলবে বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি। এটি আমাদের চাওয়া নয় বলেই আমরা এমন উচ্চাভিলাষী বাজেটের পক্ষে নই। কেননা যদিও কর আওতার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, কর রাজস্ব আহরণ আমাদের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব যখন আমরা কর রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করতে পারব। রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবার নতুন কোনো কর আরোপ করছি না। দেশে চার কোটি নাগরিক মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত। অথচ আয়কর দিচ্ছেন ২০-২২ লাখ মানুষ। এ সংখ্যা আমরা ইনশাল্লাহ দ্রুততম সময়ের মধ্যে ১ কোটিতে নিয়ে যাব। আর বাকি নাগরিকদেরও চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে করজালের আওতায় নিয়ে আসার কার্যক্রম অব্যাহত রাখব। দেশের নাগরিকরা সরকারকে রাজস্ব প্রদানে আগ্রহী। কিন্তু নানাবিধ কারণে আমরা সেই রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ হচ্ছি। এবার এদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। এর আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন বেশ কয়েকবারের অর্থমন্ত্রী। তিনিই ব্যর্থ হয়েছেন। তার ব্যর্থতায় অন্ধকার যখন চারপাশে, তখন এই বাজেট ব্যক্তিশ্রেণি ও করপোরেট করহার অপরিবর্তিত রেখেই ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বহুল আলোচিত ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইনটি চার স্তরে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। শুধু এখানেই শেষ নয়; অর্থনৈতিক প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়বে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। তবে ব্যাংক ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনাসহ ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। কিন্তু তাতে করে এবার সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সয়াবিন, পামওয়েল, সানফ্লাওয়ার ও সরিষার তেলের দাম বাড়বে। কারণ এসব পণ্য আমদানির ওপর মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। নিত্যপণ্য চিনিও বেশি দামে খেতে হবে। চিনির কাঁচামাল আমদানির ওপর স্পেসিফিক ডিউটি বাড়ানো হয়েছে। অভিভাবকদের বেশি দামে কিনতে হবে শিশুখাদ্য গুঁড়ো দুধ। এর ওপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এবার নজর দিয়েছেন বিয়ে-শাদির ব্যবসা (মিডিয়া) ঘটকালির দিকে। এখন এ ব্যবসার খরচ বাড়বে। বাড়বে জ্যোতিষী ব্যবসার খরচও। এছাড়া টিভি ও অনলাইনের অনুষ্ঠানের ব্যয়ও বাড়বে। এখন থেকে আইসক্রিম কিনতে হবে বেশি দামে। পাশাপাশি মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর খরচ বাড়বে। এতে মাশুল গুনতে হবে একেবারেই নিম্নস্তর থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের মানুষকে। আর উচ্চবিত্তদের চার্টার্ড বিমান ও হেলিকপ্টার ব্যবহারে খরচ বাড়ছে। শত শত দুঃসংবাদের ভিড়ে বেকার যুবকদের জন্য একটি সুখবর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। নতুন বাজেটে ১০০ কোটি টাকার একটি ‘স্টার্ট আপ ফান্ড’ গঠনের প্রস্তাব করেছেন। এখান থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন বেকার যুবকরা। আর বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের তিনি নিরুৎসাহিত করেননি। প্রবাসীদের আয় (রেমিট্যান্স) বৈধপথে প্রেরণে উৎসাহিত করতে নতুন অর্থবছর থেকে পাবেন ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা। পাশাপাশি প্রবাসীদের বীমা সুবিধা আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নির্বাচনীয় ইশতেহার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রাধান্য পেয়েছে। বাদ পড়েনি বেসরকারি চাকরিজীবীরাও। তাদের জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ইউনিভারসেল পেনশন অথরিটি গঠনের। এটি গঠন করা হলে সরকারি ও বেসরকারি প্রত্যেক চাকরিজীবী পেনশনের আওতায় আসবেন। বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী যদিও বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে এমন কোনো পদক্ষেপ প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এবারের বাজেট শুধু এক বছরের জন্য নয়, তৈরি করা হয়েছে ২০৪১ সালকে টার্গেট করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বাজেট সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে সরকারকে মুখোমুখি হতে হবে নানা প্রতিকূলতার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— প্রবৃদ্ধিতে অসমতা, বিনিয়োগ সংকট, সুশাসনের ঘাটতি, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, অর্থনীতির আকারে রাজস্ব আদায় কম, বৈদেশিক লেনদেন ঘাটতি। তবে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তিনি প্রবৃদ্ধিকে আগামী তিন বছরে ৮ দশমিক ৬ শতাংশের ঘরে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। বিশাল ব্যয়কে মেলাতে গিয়ে উচ্চ রাজস্ব আদায়ের হিসাবও করেছেন তিনি। আর প্রচুর কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে যার নাম বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে, সেই অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহালই রাখা হয়েছে। অর্থনীতির মূলধারায় কালো টাকাকে ফিরিয়ে আনতে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক এবং আবাসন খাতে এ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে যে স্থবিরতা, তা দূরীকরণে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং দারিদ্র্যবিমোচনেও নেই তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা। অথচ টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে আয়বৈষম্য নিয়ে এখনই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। সবমিলিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে যে ধরনের সংস্কার এবং উৎসাহমূলক পদক্ষেপ দরকার, এবারের বাজেটে তা-ও নেই। ফলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতেও এর প্রভাব পড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম একটি সমস্যা হল দরিদ্রতা। আর এ দারিদ্র্য বিমোচনের বার্ষিক গড় হার কমছে। এক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ সমস্যা সমাধানে বাজেটে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করেছিলাম কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা একটি অন্যতম ইস্যু। কিন্তু এবারের বাজেট এবং জিডিপির আনুপাতিক হারে তা বাড়েনি। সহজে বললে, এবারের বাজেটেরও প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে দূরত্ব অনেক। দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর ঘোষিত হয়েছে বাজেট। ফলে এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য কি-না তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। লেখক : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি) mominmahadi@gmail.com
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১