আপডেট : ১৮ May ২০১৯
সারা দেশে বোরো ধান কাটার উৎসব চলছে। একদিকে ফণীর প্রভাব অন্যদিকে ধানের ফলনে বিপর্যয়ে দিশাহারা কৃষক। অনেক জেলা থেকে ধানের বাম্পার ফলনের খবর এলেও তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে মজুরির কারণে। এ ছাড়া সরকারের ধানের দাম নির্ধারণের বিষয়েও কৃষকের ক্ষোভ রয়েছে। অনেক কৃষক জানাচ্ছেন, ধান চাষের খরচ থেকে কাটার মজুরি পর্যন্ত মোট যে খরচ হয়, তা ধান বিক্রি করে আসছে না। ফলে তারা বোরো চাষে অনাগ্রহের কথা জানান। আগামীতে ধানের বদলে অন্য ফসল চাষের কথা জানান তারা। এছাড়াও ঘটছে অভিনব কিছু প্রতিবাদ। প্রতিটি প্রতিবাদে কৃষকের কষ্ট ও ক্ষোভ উঠে আসে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর: টাঙ্গাইলে বিঘাপ্রতি লোকসান ৬ হাজার টাকা : জেলায় ধানের বাম্পার ফলন হলেও লোকসান গুনছেন চাষিরা। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ইরি-বোরো আবাদে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা করে ঘাটতি হচ্ছে বলে দাবি কৃষকদের। শ্রমিক সংকট, শ্রমিকের মজুরি বেশি এবং ধানের দাম কম থাকায় টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের পাকা ইরি-বোরো ধান এখনো জমিতেই পড়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে কৃষকরা এখন দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। কম দাম ও শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে না পারার হতাশা থেকে জেলার কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা এলাকার আবদুল মালেক ও বাসাইল উপজেলার কাশিল গ্রামের নজরুল ইসলাম খান সম্প্রতি তাদের নিজের পাকা ধানক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানান। জেলার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষকরা ধানের কম দাম নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে মানববন্ধন, রাস্তায় ধান ছড়িয়ে প্রতিবাদসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা জানান, ইরি-বোরো চাষে এক বিঘা জমি প্রস্তুত করতে অন্তত তিনজন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ওই সময় শ্রমিকের মজুরি থাকে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা করে। শ্রমিকের খাবারসহ দুই হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়। ট্রাক্টর বাবদ খরচ হয় প্রায় ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। বীজ ও বীজতলা প্রস্তুত করতে শ্রমিকের মূল্যসহ এক হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়। ধানের চারা রোপণ করতে তিনজন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এই তিনজন শ্রমিকের খাবারসহ দুই হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়। এরপর ধানক্ষেত থেকে ঘাস পরিষ্কার করতে অন্তত দুজন শ্রমিক লাগে। এই দুজন শ্রমিকের খাবারসহ ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো খরচ হয়ে থাকে। ধান কাটতে আবার অন্তত চারজন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি এই সময়ে প্রতিজন ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত থাকে। এই চারজন শ্রমিকের খাবারসহ চার হাজার টাকার ওপরে খরচ হয় দিনে। অপরদিকে সার বাবদ ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে বীজতলা প্রস্তুতসহ কৃষকের সোনালি ধান গোলায় তুলতে অন্তত ১৪ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। আর এই ১৪ জন শ্রমিকের খাবারসহ সব মিলিয়ে কৃষকের খরচ হচ্ছে সাড়ে ১৩ হাজার টাকার মতো। এদিকে ওই এক বিঘা জমিতে ধান হচ্ছে ১০ থেকে ১৩ মণ। ধানের বর্তমান মূল্য ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা করে। ৫৫০ টাকা হিসাবে ১৩ মণ ধানের মূল্য সাত হাজার ১৫০ টাকা। ১৩ হাজার টাকা খরচ হলে এক বিঘা জমিতে কৃষকের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টাকা করে লোকসান হচ্ছে। বাসাইল উপজেলার কলিয়া গ্রামের কৃষক আবদুর রশিদ বলেন, প্রায় ৫ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছি। এক বিঘা জমিতে ট্রাক্টর, শ্রমিক ও সারের খরচ বাবদ প্রায় ১৩ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এক বিঘা জমিতে ১০ থেকে ১৩ মণ পর্যন্ত ধান হয়। এবার ধানের দাম কম। তাই আমার প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ৬ হাজার টাকা করে লোকসান হবে। ধানক্ষেতে আগুন দেওয়া কালিহাতীর কৃষক আবদুল মালেক বলেন, ধান কাটতে শ্রমিককে দিতে হচ্ছে প্রায় এক হাজার টাকা। তারপরও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ধান কেটে বাড়িতে আনতে এক মণ ধানের পেছনে প্রায় এক হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে। ধান বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ৫০০ টাকা করে। প্রতি মণে ঘাটতি পড়ছে ৫০০ টাকা করে। তিনি আরো বলেন, ক্ষেতে ধান পাকলেও তা ঘরে তুলতে পারছিলাম না। তাই দিশাহারা হয়ে এক দাগের ৫৬ শতাংশ জমির ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। পরে এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে ধান কেটে দিয়েছে। টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, এখন শ্রমিকের মজুরি বেশি। আর বাজারে ধান মণপ্রতি ৫০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এই সময়ে ধানের বাজার কিছুটা কম থাকলেও কৃষক যদি ধান সংরক্ষণ করে রাখেন তবে কদিন পরেই অধিক মূল্য পাবেন। এবার জেলার ১২টি উপজেলায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৭০২ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়েছে বলেও তিনি জানান। দিনাজপুরে ধান কৃষকের গলার কাঁটা : দেশে ধানের জেলা হিসেবে পরিচিত দিনাজপুরে এবারে বোরো ধান গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে কৃষকদের। প্রতি মণ ধান বাজারে বিক্রি করে কৃষকরা লোকসান গুনছেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। বাজারে দামের নিম্নমুখিতার কারণে কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান দিতে পারলে মণপ্রতি লাভ হবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। চলতি বোরো মৌসুমে দিনাজপুরে ধান কেনা হবে মাত্র ৫ হাজার ৪৮ টন। যা জেলার মোট উৎপাদনের শতকরা ১ ভাগেরও কম। কৃষক ও কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর সরকারের হিসাবমতে প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে সাড়ে ১৮ টাকা। যদিও বাস্তবে উৎপাদন ব্যয় কেজিপ্রতি ২০ টাকা। কেননা ১ বিঘা জমির ধান কাটতে শ্রমিকদের দিতে হচ্ছে সাত থেকে আট হাজার টাকা। সেই সঙ্গে ধান মাড়াইয়ের জন্য মজুরি গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত এক থেকে দেড় হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এবার ৪০ কেজি মোটা ধানের জন্য উৎপাদন ব্যয় ৭৪০ টাকা হলেও বাজারে তা ৫০০ টাকায় কৃষকদের বিক্রি করতে হচ্ছে। কৃষকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর চিকন বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকা ৪০ কেজি দরে। এখানেও লোকসানের হার ১৯০ থেকে ২০০ টাকা। দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক তৌহিদুল ইকবাল জানান, জেলার ১৩টি উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭১ হেক্টরে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ২২০ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার চাইতে যা ২৫০ হেক্টর বেশি। কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এবার ধানের ফলন ছিল সন্তোষজনক। জেলায় এবার ফলন হচ্ছে ১০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬৫ টন বোরো ধান। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আশ্রাফুজ্জামান বলেন, সরকার এবার ২৬ টাকায় কেজি দরে চাল কিনছেন। দিনাজপুরে কেনা হবে মাত্র ৫ হাজার ৪৮ টন বোরো ধান। অথচ ১৩ উপজেলায় ধানের উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬৪ টন। সরকার মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনবেন ৯৩ হাজার ৮৩১ টন। খোলা বাজার থেকে কম দামে ধান কেনা শুরু করেছেন জেলার ২ হাজার ৪৭৯টি মিলের মালিকেরা। সরকার এবার সিদ্ধ চালের প্রতি কেজি ৩৬ টাকা ও আতপ চালের দর কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। হতাশ মেহেরপুরের কৃষক : বৈরী আবহাওয়া ও মাজমরা রোগের কারণে এ বছর মেহেরপুরে বোরো ধানের আশানুরূপ ফলন হয়নি। বর্তমানে জেলাজুড়ে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে। একদিকে ধানের ফলন কম অন্যদিকে ধানের দাম থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ২১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই শতাংশ জমিতে চাষ কম হয়েছে। কৃষকরা জানান, অন্য বছর বিঘাপ্রতি ২৫-২৭ মণ ফলন হলেও এ বছর বিঘাপ্রতি ১৭-১৮ মণ ফলন হয়েছে। একদিকে যেমন ফলন কম অন্যদিকে দামও কম। বর্তমানে বাজারে মোটা ধান চার থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে বিঘাপ্রতি ধান চাষ করতে ১২-১৩ হাজার টাকা খরচ হলেও ধান বিক্রি করে কৃষকের ঘরে আসছে ৭-৮ হাজার টাকা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক ড. আক্তারুজ্জামান বলেন, ঝড়-বৃষ্টির কারণে জেলায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তাতে ফলনের তারতম্য হবে না। ভালো ফলন হলে কৃষকের সেই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। তাছাড়া সরকারিভাবেই বোরো আবাদে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। বোরো আবাদে কৃষকদের খরচের পরিমাণ বাড়ে। এ ক্ষেত্রে আউশ আমন আবাদে খরচ কম আবার উৎপাদন বেশি। শেরপুরে ধানের বাজার মূল্য কম, শ্রমিক মজুরি চড়া : কৃষি ও খাদ্যসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরে এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও একদিকে উৎপাদিত ধানের বাজার মূল্য কম এবং অন্যদিকে শ্রমিক মজুরি অতি চড়া হওয়ায় এলাকার কৃষকদের মুখ থেকে হারিয়ে গেছে হাসি। তারা হতাশ হয়ে বোরো আবাদে উৎসাহ হারাচ্ছেন। জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৮৯ হাজার ৫৫৮ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ৯১ হাজার ৭২ হেক্টর জমিতে। মাঠে ফসলের ফলনও হয়েছে বাম্পার। আর ওই বাম্পার ফলন দেখে এলাকার কৃষকদের মুখে ফুটে উঠেছিল হাসির ঝিলিক। কিন্তু ফণীর প্রভাবে হালকা ঝড় বৃষ্টিতে কোনো কোনো এলাকার মাঠের ধানক্ষেতে নুয়ে পড়লে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন কৃষকরা। এর মধ্যেই ধান কাটা শুরু হলে দেখা দেয় শ্রমিক সংকট। আর্থিক অনটনে শ্রমিক মজুরি মেটাতে কাটা ধানের কিছু অংশ বাজারে তুললেও দাম একেবারেই কম। এদিকে স্থানীয় বাজারগুলোতে বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৪৫০ টাকায়। অন্যদিকে শ্রমিক সংকটে মজুরি এমন চড়া অবস্থায় পৌঁছেছে যে, প্রায় ২ মণ ধানের দামে মিলছে একজন শ্রমিক। কারণ ধান কাটায় দৈনিক একজন শ্রমিকের মজুরি দাঁড়িয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর ওই অবস্থায় এখন পর্যন্ত জেলায় প্রায় ৫০ ভাগ ধান কাটা শেষ হলেও বাকি ধান কেটে ঘরে তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা। জেলা খামারবাড়ির উপ-পরিচালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বাজারে ধানের দাম কিছুটা কম, তবে কৃষি বিভাগের তরফ থেকে বোরো আবাদের পরিবর্তে কম খরচে আউশ ধান ও ভুট্টা চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহী হতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কেননা বোরো মৌসুমে শ্রমিকের অভাব, সার-বীজসহ অন্যান্য খরচ বেশি থাকলেও আউশ ধান চাষে ওইসব খরচ কম। অন্যদিকে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার বলেন, ইতোমধ্যে ধান ও চালের বরাদ্দ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন উপজেলা খাদ্য সংগ্রহ মনিটরিং কমিটির কাজ থেকে প্রকৃত কৃষকদের তালিকা অনুযায়ী সেই কৃষকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৩ টন ধান ২৬ টাকা কেজি দরে ক্রয় করা হবে। যখন গুদামে ধান নেওয়া শুরু হবে, তখন অবশ্যই ধানের দাম বাড়বে ও কৃষকরা লাভবান হবেন।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১