বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৯ April ২০১৯

বাংলাদেশে ৩০ বছরে জঙ্গিবাদের উত্থান-পতন


বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা ১৯৮৯ সালে। এর আগে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অনেক বাংলাদেশি নাগরিক গোপনে আফগানিস্তানে গিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। তাদেরই একটি অংশ রাজপথে প্রকাশ্যে ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা করে। এরপর বহু রাজনৈতিক মেরুকরণে তারা দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ভূখণ্ডে নিজেদের ঘৃণ্য আধিপত্যের বিস্তার ঘটায়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে আইএস মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি নামের রেস্টুরেন্টে হামলা করে। এই হামলার পর জঙ্গিবাদ রুখে দিতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে সরকার। জঙ্গিবাদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে জঙ্গিদের কঠোর হাতে দমন করে সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ টিম। জঙ্গিরা এখন আর বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলা চালাতে সক্ষম নয় এবং প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে আধিপত্য বিস্তার করা ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সক্ষমতা হারিয়ে এখন দিশেহারা বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের শীর্ষ কর্তা, গোয়েন্দা বাহিনী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা।

সূত্র জানায়, ১৯৮৯ সালে স্লোগান দিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে বিএনপির শাসনামলে। ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল হরকাতুল জিহাদ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সন্মেলন করে আত্মপ্রকাশ করে। তারা ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হতে থাকে। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালে ‘শাহাদাত আল হিক্কমা’ নামে একটি সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এরপর ১৯৯৮ সালে শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইর নেতৃত্বে জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। একই সময়ে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ও হিজবুত তাওহিদ নামে আরো দুটি জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ঘটে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির, ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা ও আবু হেনা এসব জঙ্গি সংগঠন বিশেষ করে হরকাতুল জিহাদ ও জেএমবিকে মদত দিতেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের মদতে জঙ্গিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তৎপরতা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর একটি অনুষ্ঠানে প্রথম বোমা হামলা হয়। ওই বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনায় আহমদিয়া মুসলিম জামাতের (কাদিয়ানি) মসজিদে বোমা হামলায় মারা যায় আট জন এবং আহত হয় ৪০ জন। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০০’রও বেশি আহত হয়। ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায় দুটি বোমা হামলায় নিহত হয় ৩ জন এবং আহত হয় ১২৫ জনের বেশি। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর সিরিয়াল বোমা হামলা চালানো হয় ময়মনসিংহের সিনেমা হলগুলোতে। এতে নিহত হয় ১৮ জন, হামলায় আহতের সংখ্যা ছিল ৩০০। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরে এক মেলায় বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ৮ জনকে। ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি সিলেটের হজরত শাহজালাল দরগা শরিফে এক বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ১৩৮ জন। একই বছরের ২১ মে সিলেটে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে চালানো বোমা হামলায় হাইকমিশনার বেঁচে গেলেও মারা যায় অন্য দুজন, আহত হয় ২০ জন। ওই বছরই ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি ঘটে। এতে নিহত হয় ২৩ জন, আহত হয় পাঁচ শতাধিক। আওয়ামী লীগপ্রধান তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা রক্ষা পেলেও মারা যান মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভী রহমান। এ হামলায় অংশ নেয় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের একটি বৃহৎ অংশ। বিশেষ করে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের নির্দেশে এই হামলা চালানোর বিষয়টি ইতোমধ্যে আদালতে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে এ হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।

এরপর ২০০৫ সালে ১ জানুয়ারি বগুড়া ও নাটোরে বোমা হামলায় মারা যায় ৩ জন, আহত হয় সত্তরের অধিক। একই মাসে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচ জন। আহত হন ১৫০ জন। ওই বছর ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালানো হয়। এ হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা তাদের অপারেশনাল সক্ষমতা ও শক্ত অবস্থানের কথা জানান দেয়। ওই হামলায় ২ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এর দুই মাস পর নভেম্বরের ১৪ তারিখে ঝালকাঠিতে দুজন সহকারী জেলা জজকে বোমা মেরে হত্যা করে জঙ্গিরা। ২৯ নভেম্বরে চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে একসঙ্গে বোমা হামলা করা হয়। এ হামলায় নিহতের সংখ্যা ৯, আহতের হয় ৭৮ জন। ২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর  নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ের সামনে এক বোমা হামলায় নিহত হয় ৮ জন, আহত ৪৮ জন।

একের পর এক হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয় দেশ। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাধ্য হয় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে। পুলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করলে জঙ্গিরা একে একে ধরা পড়তে থাকে। এক পর্যায়ে শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইকেও গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাদের ফাঁসির রায় হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই দুজনসহ শীর্ষ জঙ্গিদের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রাথমিক জঙ্গিবাদের অবসান ঘটে।

তবে সরকার ও সরকারের প্রশাসনযন্ত্র ধরেই নেয় বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সংঘটিত হতে থাকে জঙ্গিরা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে বড় ধরনের হামলার মধ্য দিয়ে তারা আবারো শক্ত অবস্থান জানান দেয়। এরপর ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে পুলিশ জঙ্গিদের তখতে তাউস উল্টে দিতে একের পর এক সফল অভিযান পরিচালনা করে। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে পাঁচ শতাধিক জঙ্গি গ্রেফতার হয়— ধ্বংস হয় অর্ধশত ঘাঁটি এবং নিহত হয় ৫৯ শীর্ষ জঙ্গি। হলি আর্টিজানে হামলার এক সপ্তাহ পরই আইএস এক ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশে আবারো হামলার হুমকি দেয় কিন্তু পারেনি। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় গির্জা ও হোটেলে জঙ্গি হামলার পর আইএস আবারো বাংলাদেশে হামলার হুমকি দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের ডিআইজি (প্রশাসন) মো. হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বড় ধরনের হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা জঙ্গিদের নেই। জঙ্গিদের গডফাদার, মাস্টারমাইন্ড, অর্থ ও অস্ত্র জোগানদাতারা এখন আর সক্রিয় নয়। তারা ইতোমধ্যে কেউ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে, কেউ জেলে আছে। আবার কেউ কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। মাঠ পর্যায়ের কিছু নবীন সদস্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে পারে। তারাও আছে দৌড়ের ওপর। তাই বলে আমরা চুপটি করে বসে নেই। সারা দেশে পুলিশ বাহিনী সতর্ক আছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, পুলিশের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের মসজিদ, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জঙ্গিবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষ ভীষণ রকমের সচেতন। তারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে বরাবরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করে থাকে। ফলে জঙ্গিরা বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিতাড়িত।

জঙ্গি পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলগুলোও ইতোমধ্যে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে দাবি করে পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আছে। যে সরকারের নেতৃত্বে থাকা দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ইতোপূর্বে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছেন। সরকারপ্রধানকেও একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই সরকার জঙ্গিদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না। ‘যেখানেই জঙ্গি সেখানেই অভিযান’ এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আাাইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। এটা অব্যাহত থাকবে। জঙ্গিরা বাংলাদেশে আর সুবিধা করতে পারবে বলে আমি মনে করি না।

এ ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, জঙ্গি-ঝুঁকি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও থাকতে পারে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো থ্রেট নেই। কারণ বাংলাদেশের আইন-শৃৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন অব্যাহত রেখেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করছে। এ কারণে দ্রুত সাফল্য এসেছে। বাংলাদেশ পুলিশ  জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সতরাং এভাবে চোখ-কান খোলা রেখে দায়িত্ব পালন করে গেলে জঙ্গিরা শুধু হুমকিই দিতে পারবে, হামলা করতে পারবে না।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১