বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ৩০ March ২০১৯

এক কিশোরের স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ


মুক্তিযুদ্ধকে আমি খুব সামনে থেকে দেখেছি। আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বোঝার মতো জ্ঞান না হলেও রাজনীতির গলিতে পা রেখেছি তার আগেই। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে বড়ভাইদের সঙ্গে মিছিলে গিয়ে যখন স্লোগান ধরতাম ‘আইয়ুব-মোনেম দুই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই’, ‘আসাদের মন্ত্র, জনগণতন্ত্র’, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’- তখন আশ্চর্য এক রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের, মানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে- এ কথা আমাদের মর্মমূলে গেঁথে গিয়েছিল সেই কিশোর বয়সেই। ওই গোলামি থেকে কীভাবে মুক্তিলাভ করা যায়, এ নিয়ে বড়রা আলোচনা করতেন, আমরা শুনতাম। সবার কথা ছিল একটাই- পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা বাঙালিদের হাতে না এলে শোষণ-বঞ্চনার অবসান হবে না। এখানে বলে নেওয়া দরকার যে, আমার বড়ভাই গিয়াসউদ্দিন খান বাদল তখন পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে এলে তার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনায় মেতে উঠতেন গ্রামের অন্যরা।

আমার এ লেখাটি মূলত স্মৃতিচারণমূলক। কিশোর বয়সে আমার চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধকে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সবাইকে আশান্বিত করে তোলে। এবার বাঙালিরা ক্ষমতায় যাচ্ছে এটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু পরবর্তীকালে যেসব ঘটনা ঘটতে থাকে, গ্রামের মানুষও বুঝতে পারে কিছু একটা ঘোট পাকানোর চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যেদিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করলেন, সেদিনই শ্রীনগর কলেজ থেকে ছাত্ররা মিছিল বের করল। আমরাও সে মিছিলে যোগ দিলাম। মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছাত্রনেতা জয়নাল আবেদীন (পরে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক)। ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা মানি না মানি না’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- স্লোগানে সেদিন শ্রীনগরের মাটি কেঁপে উঠেছিল। এগিয়ে এলো ৭ মার্চ। শেখ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন, রেডিওতে তা প্রচার করা হবে- এ কথা জানার পর উৎসুক হয়ে রইলাম। কিন্তু সেদিন আমরা তার ভাষণ শুনতে পেলাম না। রেডিওর নব ঘুরিয়ে পাওয়া গেল না ঢাকা স্টেশনের আওয়াজ। রাতে জানতে পারলাম পরদিন সকালে ভাষণটি প্রচার করা হবে। তখন গ্রামে রেডিও ছিল কম। আমার নানাবাড়িতে একজনের রেডিও ছিল, আমরা সেখানেই জড়ো হলাম। সবাই মিলে শুনলাম সে ভাষণ। তার ভাষণ শেষ হওয়ার পর আলোচনা শুরু হলো- এরপর কী? আলোচনা, নাকি যুদ্ধ? বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে শুনতে পাই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিব আলোচনা করছেন। এভাবে চলতে থাকল কয়েকদিন। ঢাকার ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে তখন গ্রামে। আমরা বাঁধনহারা এক দঙ্গল বালক পুরো গ্রাম দাঁপিয়ে বেড়াই। বড়রা মাঝে মধ্যে মাইক ভাড়া করে এনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড বাজায়। আমরা শুনি আর মুখস্থ করি।

ঢাকায় কী হচ্ছে না হচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই। সন্ধ্যার পর বিবিসি থেকে কিছু খবর পাওয়া যায়। ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকেই ঢাকার দিক থেকে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ আসতে থাকে। ২৬ মার্চ খবর পাওয়া গেল আগের রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় বেশুমার মানুষকে হত্যা করেছে। সবাই চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত। ২৭ মার্চ শুরু হলো প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ঢাকা ছেড়ে আসা মানুষের মিছিল। তারা কেউ যাবে ফরিদপুর, কেউ যাবে বরিশাল। ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত ওই মানুষগুলোকে গ্রামবাসী যথাসাধ্য সাহায্য করতে থাকলেন। কেউ একটু বিশ্রাম নিয়ে চলে গেল। আবার কিছু লোক রাতটা কাটানোর জন্য থেকেও গেল। ওইদিন সন্ধ্যার পর শোনা গেল মেজর জিয়া নামে এক লোক স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। আমরা আমাদের দরগাহবাড়িতে ভিড় করলাম রেডিওতে তা শোনার জন্য। অত্যন্ত ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছিল। রতনকাকা কানের কাছে রেডিও নিয়ে শুনলেন। আর বললেন- হ্যাঁ, জিয়া নামে একজন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। পরদিন দুপুরে বড়দা বাড়ি এলেন। তিনিও মেজর জিয়ার ঘোষণার কথা বললেন।

আমাদের এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী এসেছিল মে মাসের ৯ তারিখে। তারা শ্রীনগর বাজারের আশপাশের বেশকিছু হিন্দুবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। পাকবাহিনী আমাদের এখানে ক্যাম্প করে স্থানীয় ডাকবাংলোয়। সংলগ্ন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসও তারা দখলে নেয়। আগস্ট মাসে হানাদার বাহিনী আমাদের এলাকায় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেল। এক দুপুরে নৌকায় চড়ে ওরা বেরিয়েছিল টহলে। আমাদের গ্রামের পশ্চিমের গ্রাম কামারখোলা। ওই বরাবর ওরা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের কবলে পড়ে। একজন পাকসেনা মারা যায়। এর কয়েকদিন পরে শোনা গেল শ্রীনগরে আরো পাকিস্তানি সৈন্য এসেছে। রাতে খবর এলো পরদিন ওরা গ্রামে ঢুকবে। আমাদের গ্রামটি শ্রীনগর থেকে এক মাইল দক্ষিণে এবং বড়খালের সন্নিকটে। গ্রামের সবাই রাতের অন্ধকারে সবকিছু ছেড়েছুড়ে আশ্রয় নিল প্রায় দেড় মাইল পূর্বদিকে নাগরভাগ প্রাইমারি স্কুলে। পরদিন সেখান থেকে আমরা চলে গেলাম আটপাড়ায় আমার ছোট খালার বাড়িতে। সেখানে বসেই খবর পেলাম পাকবাহিনী বড়খালের দু’পাশের অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এর কয়েকদিন পর আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় আড়াই মাইল দক্ষিণে গোয়ালীমান্দ্রা হাটে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের শিকার হয়। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। সে যুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বিয়াল্লিশ ফুট উঁচু একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছেন। স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পূর্তিতে সেটি উদ্বোধন করা হয়েছে।  

আমাদের এলাকা হানাদারমুক্ত হয় ১৭ নভেম্বর। ওইদিন সকাল দশটার দিকে শ্রীনগর ডাকবাংলো থেকে হানাদার বাহিনীর দলটি যাত্রা শুরু করে লৌহজংয়ের দিকে। আবারো সেই কামারখোলায় অক্রমণ। বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করতে থাকে পাকবাহিনী। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে তারা দিশাহারা হয়ে পড়ে। ছত্রভঙ্গ হানাদার সৈন্যরা জীবন বাঁচাতে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকে। আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যায় বুলেট। এরই মধ্যে দেখা যায় আমাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ‘জমদুয়ারি খালে’র পাড়ে একটি পাকসেনা। আমার চাচাতো ভাই আজহারউদ্দিন আনিস ছুটলেন উদ্ধত ছোরা হাতে। কারো বাধাই মানলেন না। আমরা দেখলাম আহাদ খান কাকা ওই হানাদারটিকে বৈঠা দিয়ে পেটাচ্ছেন। আর পরমুহূর্তেই আনিস দা ওটাকে কুপিয়ে হত্যা করলেন। আমরা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। সে যুদ্ধে ষাটজন পাকসেনার একজনও জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি। এ যুদ্ধকে উপজীব্য করে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ফয়েজ আহমদ ‘শ্রীনগরে যুদ্ধ’ কবিতাটি লিখেছিলেন। উল্লেখ্য, তিনি শ্রীনগর উপজেলার বাসাইলভোগ গ্রামের সন্তান। পরপর কয়েকটি পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে কয়েকদিন পর ঢাকা থেকে হানাদার বাহিনীর এক বিরাট কনভয় এগিয়ে আসতে থাকে শ্রীনগরের দিকে। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধারা ওদের ঠেকিয়ে দেয় সিরাজদিখান থানার সৈয়দপুরে। ফলে ধলেশ্বরী নদী পার হতে পারেনি ওরা। সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওমর।

নভেম্বরের শেষদিকে বড়দা গ্রামে ফিরে এলেন। গ্রামের যুবকরা সিদ্ধান্ত নিলেন একটি পত্রিকা বের করবেন। সম্পাদক বড়দা। বড় চাচার বাংলাঘরে পত্রিকার অফিস। গ্রামের সব যুবক সাংবাদিক। মূলত রেডিওর খবর শুনে তা হাতে লিখে প্রকাশ করা। আমরা হলাম হকার। মুক্ত শ্রীনগরের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে, সরকারি অফিসসহ কয়েক জায়গায় তা পৌঁছে দিই আমি ও চাচাতো ভাই লিটন। ‘বাংলার ছবি’ নামের হাতে লেখা সে পত্রিকাটি স্বাধীনতার পরও কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়েছিল।

ডিসেম্বর মাসের পাঁচ তারিখে ভারত যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল, আমরা নিশ্চিত হলাম স্বাধীনতার বেশি বাকি নেই। তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিবিসি থেকে আমরা জানতে পারলাম বিকালে রেসকোর্স ময়দানে পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। বড়দা, আমি, ছোটভাই মেজবাহ, চাচাতো ভাই লিটন ও রুহুল আমিন হারিকেন হাতে বেরিয়ে পড়লাম। বড়দা ‘জয় বাংলা’ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। আমরাও তার সঙ্গে গলা মিলালাম। তারপর বিভিন্ন বাড়ি থেকে কেউ টর্চ হাতে, কেউ হারিকেন হাতে বেরিয়ে এলো। তাসেরদা (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক মাহমুদ খান তাসের) বলিষ্ঠ কণ্ঠে স্লোগান ধরলেন- ‘স্বাধীন হলো স্বাধীন হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। পৌষের কনকনে শীত তখন স্বাধীনতার আনন্দে মাতোয়ারা আমাদের শরীরকে স্পর্শ করতে পারছে না। প্রায় ঘণ্টাখানেক পুরো গ্রামজুড়ে মিছিল চলল। চারদিক থেকে আসছিল হর্ষধ্বনি। কেউ কেউ আনন্দে কেঁদে ফেলল।

পরদিন সকালে আমরা চললাম শ্রীনগরে, আমাদের থানা সদরে। গিয়ে দেখলাম স্বাধীনতার আনন্দে শ্রীগরের মাটি যেন দুলছে। ক’মাস আগেও যে শ্রীনগর বাজার ছিল প্রায় বিরানভূমি, আজ সেখানে চলছে বিরামহীন জনস্রোত। মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলিবর্ষণ করছে। যে গুলির আওয়াজ ক’দিন আগেও সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতো, সে গুলির আওয়াজ আজ সবাইকে উদ্বেলিত করছে এক অপার আনন্দে! একটি দেশ, একটি জাতির স্বাধীন হওয়া সে দেশের মানুষের কাছে যে কী আনন্দের, তা যারা একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর দেখেনি, তাদের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। দুপুর পর্যন্ত শ্রীনগরের মাটি দাপিয়ে আমরা ফিরে এলাম বাড়িতে।

আমার এ জীবনে অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত এসেছে। কিন্তু একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর স্বাধীনতার যে আনন্দ আমাকে উদ্বেলিত করেছিল, তার সঙ্গে অন্য কোনো আনন্দের তুলনা হয় না। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, কারণ আমি একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হতে দেখেছি। দেখেছি স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হতে। নিজের হাতে আকাশে তুলে ধরতে পেরেছি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এমন সৌভাগ্য তো সবার হয় না।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১