আপডেট : ১৫ March ২০১৯
বাসাবাড়ি, শিল্প-কারখানা ও গণপরিবহনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত সঙ্কুুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসসহ (সিএনজি) সব ধরনের প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বিতরণকারী সংস্থাগুলো। আর এমন প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাব দেশের সব স্তরের মানুষের ওপর পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে, নিত্যপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে সেই বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়েও। পাশাপাশি বেড়ে যাবে গণপরিবহনের ভাড়াও। এতে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের উৎপাদনশীল খাতের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল ও জ্বালানিই হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস। ব্যবসায়িক মন্দা অবস্থার মধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে টিকে থাকতে না পারার কারণে অনেককেই পড়তে হবে বড় ধরনের লোকসানে। বন্ধ হয়েও যেতে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। উৎপাদন খাত ছাড়াও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে দেশের পরিবহন খাতও। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ কয়েকটি জেলা শহরে সিএনজিচালিত গণপরিবহন থাকলেও দাম বৃদ্ধির প্রভাব পুরো দেশের ওপরই পড়বে বলে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বর্তমানে দেশের অধিকাংশ দূরপাল্লার গণপরিবহন দ্বৈত জ্বালানি ব্যবহার করছে। এ ব্যাপারে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, শুধু বাসাবাড়িতে ব্যবহূত গ্যাসেরও যদি দাম বাড়ানো হয়, তাহলে তার কুফল দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপরেই পড়বে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেসব অঞ্চলে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ রয়েছে তাদের প্রত্যেকের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। আর এসব জনগণকে বাদ দিয়ে তো জাতীয় প্রবৃদ্ধি হিসাব করা সম্ভব নয়। তাহলে যদি সব স্তরে গ্যাসের দাম বাড়ে তাহলে সেই প্রভাব আরো ভয়াবহ আকারে দেখা দেবে। তিনি বলেন, রফতানিযোগ্য পণ্য যদি বাদও দিই, তাহলে দেশের বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামালই গ্যাস। আর গ্যাসের দাম বাড়লে এসব পণ্যে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, ফলে বেড়ে যাবে বিক্রয়মূল্য। এতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত মানুষেরও জীবনযাত্রার ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলবে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটি করপোরশেন এলাকায় প্রায় অর্ধকোটি জনগণের বসবাস। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার হয় গ্যাস। তাই দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে নাখোশ গ্রাহকরা। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে শঙ্কায় চট্টগ্রাম, সিলেট, লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলের আবাসিক গ্রাহকরাও। তাদের অভিযোগ, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত না করেই দাম বাড়ানোর এমন প্রস্তাব অযৌক্তিক। নিত্যপণ্যের দামেও পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। জেলা প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এই প্রভাব পড়েছে সব জেলাতেই। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের অটোরিকশা চালকরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে যাত্রী পর্যায়ে ব্যয় বাড়বে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। এ অঞ্চলের ৪ জেলার বিভিন্ন স্থানে ২৭টি সিএনজি ফিলিং স্টেশনে এখন প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৫৫ লাখ ৭৫ হাজার ঘনমিটার সিএনজি বিক্রি করে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি- পিজিসিএল। রাজধানীতে চলা গণশুনানিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তিতাস, বাখরাবাদ ও জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো চুলার সংখ্যার ভিত্তিতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবটি করে তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলীসহ ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাবনাটি করা হয়। সেখানে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে তিতাস কোম্পানি প্রস্তাব করে, গ্যাসের মূল্য এক চুলা ৭৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৩৫০ টাকা এবং দুই চুলা ৮০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৪৪০ টাকায় উন্নীত করতে প্রস্তাব রাখে তারা। অর্থাৎ আবাসিক খাতে গ্যাসের বর্তমান মূল্যের প্রায় ১০২.৮৫ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও গত বছর একবার বিইআরসি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করেছিল কিন্তু ওই দাম গ্রাহকদের বহন করতে হয়নি। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাবি মেনে এক বছরে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা সরকার বহন করেছে। সম্প্র্রতি তাই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব ব্যবসায়ী ও জনসাধারণের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি করেছে। ব্যবসায়ীরা এই প্রস্তাবকে অবৈধ বলে দাবি করেছেন। এদিকে সাধারণ গ্রাহকরাও এই বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। রান্নার জ্বালানি হিসেবে মাসিক সর্বোচ্চ ১৪৪০ টাকা খরচ বহন করা নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয় মিরপুর নিবাসী গৃহিণী তাহুমি হাবিবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মধ্যবিত্তদের মাসিক আয় খুব সীমিত। এই সীমিত আয় আমাদের হিসাব করে খরচ করতে হয়। এমতাবস্থায় অনাকাঙ্ক্ষিত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি হলে আর্থিকভাবে আমাদের অনেকটাই বিপদে ফেলে দেবে। আর গ্যাসের এই উচ্চমূল্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ অন্যদিকে শ্যামলীর বাসিন্দা ফারজানা ইসলাম আঁখিকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আর্থিক দিক থেকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের জীবনযাত্রার মান এখনো এতটা উন্নত হয়নি যে তারা রান্নার জ্বালানির পেছনে এত বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারবে। যাদের হিসাবের সংসার তাদের পক্ষে তো এটা শাস্তির মতোই বিষয়’। এই বিষয়ে আরো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মোহাম্মদপুর নিবাসী মো. আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যদি গ্যাসের অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি করা হয় তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য তা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। সাধারণ মানুষের বেতন তেমন বাড়ে না কিন্তু ঠিকই পণ্যের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। মানুষের উপার্জন করা টাকার সঙ্গে যেটা খুবই বেমানান। তাই আমার কাছে মনে হচ্ছে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে হলেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা ঠিক হবে না’। গ্যাসের এই মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে গৃহিণী থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের ভোক্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শঙ্কা ও ক্ষোভ। বিশেষ করে ঢাকা শহরে যারা ব্যাচেলর/ছাত্রছাত্রী/ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছেন, যাদের শক্ত আর্থিক অবস্থান নেই তাদের জন্য গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি খুব চাপ সৃষ্টি করবে বলেই মনে করেন সাধারণ গ্রাহক। ঢাকার বাইরেও গ্যাস ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে অসন্তুষ্টি লক্ষ করা গেছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে খুলনা মহানগরীর টুটপাড়া এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিনিয়ত নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়ে চলেছে। এতে মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা করুণ হয়ে পড়েছে। তার ওপর গ্যাসের দাম গত তিন মাসের মধ্যে যদি আবারো বৃদ্ধি হয় তাহলে তা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো হয়ে দেখা দেবে’। নগরীর আহসান আহমেদ রোডের বাসিন্দা রোজি রহমান বলেন, ‘নির্ধারিত বেতনের চাকরি যারা করেন তাদের মাস শেষ করতে হয় অনেক হিসাব করে। এর মধ্যে যদি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় তাহলে অনেক কিছু ছাঁটাই করতে হবে হিসাবের খাতা থেকে।’
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১