আপডেট : ১১ March ২০১৯
বই মেলা গত হয়েছে কিছুদিন হলো। মেলায় গিয়েছিলাম কয়েকদিন। তার মধ্যে একদিনের কথা কিঞ্চিৎ বর্ণনা করি। বই মেলায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটি সুখী (অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো) দম্পতির ওপর চোখ পড়ল। বলতে পারেন শুভ দৃষ্টি পড়ল। কৌতূহলবশত তাদের ফলো করে হাঁটছিলাম। তাদের রূপদর্শন আমার উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল না গোপন কিছু শ্রবণ করা, উদ্দেশ্য ছিল কেবল নব-দম্পতির অভিরুচি বা তারা কী ধরনের বই পছন্দ করেন বা কেনেন তা প্রত্যক্ষ করা। একটি স্টলে এই দম্পতি থামলেন। পুরুষ লোকটি একটি বই খুলে দেখলেন। এরপর স্ত্রীর দিকে বইটি দিয়ে বললেন, দেখো তো বইটি কেমন? স্ত্রীলোকটি এক আঙুলের আগা দিয়ে আলতো করে কভার পৃষ্ঠাটি উল্টালেন, যেন মনে হলো আঙুলে এই মাত্র মেহেদি দিয়েছেন আর বইটি ধরায় তার আঙুলের মেহেদি অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে গেল। তারপর স্বামীর হাত ধরে টেনে সরে পড়লেন। আমি গভীর উত্তেজনায় লক্ষ করলাম, আরেকটি স্টলে এই দম্পতি প্রবেশ করলেন, এবার ভদ্রমহিলা একটি বইয়ের একটিমাত্র পাতা উল্টালেন এবং তড়িগড়ি করে বইটি রেখে অনুরূপ অভিনয় মঞ্চায়িত করলেন। বা অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করলেন। স্টলের বিক্রয়কর্মী বললেন, আপু, বই নেবেন না? প্রত্যুত্তরে মহিলা ঠোঁট ফাটা হাসি উপহার দিয়ে বললেন, পরে নেব। তার হাবভাব দেখে মনে হলো, প্রতিটি স্টল যেন ১৪৪ ধারা জারি করা নিষিদ্ধ অঞ্চল। তার তাড়াহুড়ো দেখে মনে হলো এই বুঝি কেউ তাদের কৃতকর্মটি দেখে ফেলছে, আর দেখে ফেলা মানেই আইসিটি আইনে মামলা ঠুকে দেওয়া! মামলা হলেই স্বামী আর স্ত্রীকে আলাদা আলাদা জেলে অনন্ত দিনের জন্য রাখা হবে। ফলে তাদের সুখের রাতযাপনের ইতি ঘটবে। সুতরাং স্ত্রী স্বামীর বাম হাতটি তার ডান বগলের নিচে রেখে টানতে টানতে লেকের পাড়ে চলে গেলেন। অতঃপর দুজনে মিলে প্রাণভরে বিনা টাকায় উপভোগ করলেন লেকের অপার সৌন্দর্য-মহিমা। বিনা টাকায় লেকের হূদয় জুড়ানো সৌন্দর্য উপভোগ করে বই মেলায় আসার সার্থকতা প্রমাণ করলেন। কিছুক্ষণ পর এই দম্পতি মেলার এক কোণে স্থাপিত খাবার দোকানে ঢুকলেন। তারা মোরগ-পোলাও দিয়ে ভূরিভোজন সারলেন। ভূড়িভোজন পর্বে শাহী খাবার-দাবার বাবদ ৫০০ টাকার একটি নতুন-চকচকে নোট পে করলেন। অবশেষে তারা হেলেদুলে মেলা থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই দম্পতির কাছ থেকে আমরা কী শিক্ষা পেলাম? আসলে এই দম্পতিকে রূপক অর্থে দেখানো হয়েছে। এই দম্পতির মতো শত শত আম-পাবলিক বই মেলায় আসে ঠিকই কিন্তু তারা মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য ১০০ টাকা দামে একটি বই কিনতে কৃপণতা করে, মনের খোরাক সাধনের বস্তুটি কিনতে তারা লাজুক-লতার মতো চুপসে যায়। অথচ মেলায় এসে ভূরিভোজনের বেলায় তারা দানবীর, মহামতি, বৃহৎ মনের মহৎ মানুষে পরিণত হয়। একবেলার খাদ্য পরের বেলা অপবিত্র জিনিস হয়ে ঠাঁই নেবে আঁস্তাকুড়ে; কিন্তু একটি ভালো বই বছরের পর বছর ধরে টিকে থাকে। একবেলা খাবারের এই টাকায় কেনা দু-তিনটি বই হতে পারত তাদের চিত্তাকর্ষণের মাধ্যম। বছরের পর বছর ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে কাজে লাগতে পারত। হতে পারত জ্ঞান-গরিমা, রুচিবোধের গর্বিত পরিচায়ক। কেউ কেউ দোকানে এমনকি মেলায় বই কিনতে গিয়ে দরাদরি করে। এমনকি দাম বেশি রাখার অভিযোগে অনেক সময় বইটি রেখে চলে যায়। তারা একটি বারও চিন্তা করে না একটি বই মেলায় বা দোকানে আসার আগে কতটা ধাপ পার করতে হয়। কত টাকা খরচ হয় এই ধাপগুলো পাড়ি দিতে। অথচ এই লোকটিই ষাট টাকা দামের তিন প্যাকেট সিগারেট ফোঁকে চব্বিশ ঘণ্টায়। অবশ্য ধূমপায়ীরা সিগারেট টানাকে বলে সুখটান। সে হিসেবে দৈনিক ১৮০ টাকা ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েও তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে অথচ ধূমপায়ীরা বছরে দুটি বই কিনতে গিয়েও মলাটে মূল্য দেখে আঁতকে ওঠে। ভয়ে বুকে থুতু দেয়। একটি গল্প বলি। এক লোকের টয়লেটে যাওয়ার বোধ অনুভূত হলো। কিন্তু ভদ্রলোক তখন ঠিক মাঠের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আশপাশে কোনো বাড়ি না থাকায় তিনি ক্ষেতের আইলেই তার জরুরি কাজটি সারতে বসে পড়লেন। আর ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়’-এর মতো তিনি দেখতে পেলেন একজন লোক তার পাশ দিয়েই যাচ্ছে। তার খুব লজ্জা হলো। কিন্তু তখন তিনি চরম মুহূর্তে ছিলেন। কী করবেন কিছুই ভেবে পেলেন না। লজ্জায় তার মুখ নিচের দিকে গমন করতে শুরু করল। একপর্যায়ে তিনি মাথা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। তার পশ্চাৎদেশ ৯০ ডিগ্রি উপরে উঠে এলো। ঘটনা কী দাঁড়াল? ওই ব্যক্তি চক্ষুলজ্জা বাঁচাতে গিয়ে পশ্চাৎদেশের লজ্জা বিলিয়ে দিলেন বিনা দামে। গল্পটা বলার পেছনের গল্পটা হলো এই— এ পর্যন্ত আমার বেশ ক’টি বই বের হয়েছে। অনেক পরিচিত-অপরিচিত লোক আমার কাছে আমার রচিত বই চান। আমি কয়েকটি লাইব্রেরির নাম উল্লেখ করে বলে দিই, সেখানে আমার বইগুলো পাবেন। তখন কেউ কেউ বলেন, ভাই গতকাল ওই লাইব্রেরিতে আপনার বইগুলো দেখেছি কিন্তু কিনতে পারিনি। লজ্জা লাগে। উপন্যাস বা গল্পের বই কিনলে দোকানি বা পাশের লোক কী ভাববে? তাই আপনি এমনভাবে একটি বই দেন, যাতে কেউ জানতে না পারে। এবার চিন্তা করুন, একটি গল্প বা উপন্যাসের বই কিনলে ওইসব ভদ্রলোকের লজ্জা লাগে, অথচ প্রতিদিনকার বিভিন্ন ধরনের বাজার করতে তো আপনার লজ্জা লাগে না? বাজার থেকে কেজি কেজি গোলআলু কিনে বস্তা মাথায় করে বাড়ি যান, কোথায় লজ্জা লাগে না তো! স্ত্রীর জন্য পেন্টি কিংবা বাজারের সর্ববৃহৎ সাইজের ব্রা কেনার সময় লজ্জা পান তো! এমনকি জন্মবিরতিকরণ পণ্য কেনার সময় আপনার লজ্জা কোন পকেটে থাকে বাপু? অথচ একটি বই কেনার সময় লজ্জা যেন ভাতের ফেনের মতো উথলে পড়ে। বই কেনার সময় লজ্জায় পরনের কাপড় পর্যন্ত ভিজিয়ে ফেলেন। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি, এই ডিজিটাল যুগে আমরা জাতি হিসেবে বেশ অলস বা আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছি। আমাদের বই পড়তে গেলে শরীরের অবসাদ বেড়ে যায়। আমরা খুব দ্রুত টায়ার্ড হয়ে পড়ি, দু’চোখজুড়ে ঘুম নেমে আসে। ডিজিটাল যুগে আমরা এখন ছেলেমেয়ের জন্য যেমন খুঁজি ‘একের ভেতর সব’ জাতীয় বই, তেমনি নিজেদের বিনোদনের জন্য খুঁজি ‘একের ভেতর সব’ জাতীয় বিনোদন মাধ্যম। এ ধরনের একটি বিনোদন মাধ্যম হলো টেলিভিশন, যেখানে পরিশ্রমের বালাই নেই। আরামপ্রদ খাটে চার হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকলেও চলে; কেবল কষ্ট করে চোখ দুটি খোলা রাখলেই শত বিনোদনের পসরা হাজির। আমরা ইদানীং আন্তর্জাতিক বিনোদনখেকোতে পরিণত হয়েছি। দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে আমাদের ভীষণ অরুচি, তীব্র অ্যালার্জি। স্টার জলসা বা জি বাংলার মতো আন্তর্জাতিক চ্যানেল হলে আমাদের ঘুম উধাও হয়ে যায়। তন্ময় হয়ে আমরা এসব জিনিস দেখি। এসব চ্যানেলে আসক্ত হয়ে আমাদের মা-বোনদের চুলায় ভাত পোড়ে, টেবিলে ইস্ত্রির কাপড় জ্বলে। এমনও ঘটনা দেখা গেছে, অনেকের এই টিভির সামনেই চলে খাওয়া পর্ব। তারা হাতে প্লেট রেখে সিরিয়ালের দিকে এতই মনোযোগী হয়ে পড়ে যে, বদমাইশ মুরগি কখন যে তার প্লেটে ইয়ে করে চলে গেছে, তারা তা টেরই পায়নি এবং এসব ইয়েকে তরকারি ভেবে তারা গোগ্রাসে ভক্ষণ করেছে ভাতের সঙ্গে। অজান্তে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় সড়রহ৪১২৯০২—মসধরষ.পড়স
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১