আপডেট : ০৬ March ২০১৯
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, গত সংখ্যায় নিবন্ধ শেষ করার আগে জানিয়েছিলাম, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় ইন্টারোগেশনের জবাব দেওয়ার এক ফাঁকে আগরতলা (ষড়যন্ত্র) মামলার প্রধান অভিযুক্ত এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সেনা অফিসারদের অনুরোধ করেছিলেন, তারা যাতে তার লেখা একটি চিঠি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। শেখ মুজিব ওই অফিসারদের আরো বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, এদেশের লোক বিশ্বাস করবে না আর করতে পারে না যে, আমি ষড়যন্ত্র করতে পারি। আমার চরিত্র সম্বন্ধে তাদের ধারণা আছে। আমাকে জড়িত করে (আপনারা) দেশের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই করলেন।’ চিঠি লেখার কারণ জানাতে গিয়ে শেখ মুজিব জানিয়েছেন, তার তখন পর্যন্ত ধারণা ছিল, ‘তিনি (প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান) ইচ্ছা করলে (ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়টিতে) হস্তক্ষেপ করতে পারেন।’ (পৃষ্ঠা ২৬১) এই অনুরোধের জবাবে অফিসাররা বলেছিলেন, ‘চিঠি আমরা নিতে পারব না। তবে যদি টেপরেকর্ডে আপনি কিছু বলতে চান বলে দিবেন— আমরা তাকে (অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে) শুনাবো।’ ইন্টারোগেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা অবশ্য দু-একদিনের মধ্যেই পরিবর্তিত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। সম্ভবত সরকারের নির্দেশে বলেছিলেন, চিঠির শেষের দিকে পরিবর্তন করলে তারা নিতে পারেন। বন্দি নেতা শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘(অফিসারদের কথা শুনে) বললাম, ঠিক আছে বলুন কি লিখতে হবে। ব্রিগেডিয়ার আকবর বললেন, আমি লিখে নিলাম। তারপর আর একটা কাগজে নূতন করে লিখে তার হাতে দিলাম। তারা বললেন, পিন্ডি যেয়ে চিঠি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দিব। তিনি কি বলেন আপনাকে জানাবো।’ এই চিঠি প্রসঙ্গে শেখ মুজিব আরো লিখেছেন, ‘চিঠির শেষের প্যারাটা (অফিসাররা) আমাকে বাধ্য করল লিখতে। না লিখে উপায় ছিল না। ইজ্জতের ভয়েই লিখতে হলো।...’ (পৃষ্ঠা ২৬০-৬৩) উল্লেখ্য, আগরতলা (ষড়যন্ত্র) মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে বন্দি থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন এবং যে চিঠির শেষের প্যারাটা লিখতে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল, এখনো সে চিঠির খোঁজ যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনি জানা যায়নি সেনা অফিসাররা ঠিক কী কথা তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। সরকারের উচিত পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে ওই চিঠিটি উদ্ধার করা এবং জনগণকে জানানোর কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া। আগেই উল্লেখ করেছি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার দীর্ঘ পাঁচ মাস পর বন্দি নেতা শেখ মুজিবকে ৩২০ পৃষ্ঠার একটি রুলটানা খাতা দেওয়া হয়েছিল। খাতাটি পাঠিয়েছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। সে খাতারও মাত্র ৫২ পৃষ্ঠা শেখ মুজিব লিখতে পেরেছিলেন। গ্রন্থে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৬ পৃষ্ঠা (২৫২ থেকে ২৬৭)। এরই এক স্থানে তিনি (শেখ মুজিব) লিখেছেন, ‘পাঁচ মাস পর খাতা পেয়েছি। তাই দিন তারিখগুলি আমার মনে নাই, ঘটনাগুলি যতদূর মনে পড়ে তা-ই লিখে রাখছি।’ (পৃষ্ঠা ২৫৯) ক্যান্টনমেন্টের দিনগুলো সম্পর্কে শেখ মুজিব অবশ্য বিস্তারিত লিখতে ও জানাতে পারেননি। যেটুকু লিখেছেন, তা থেকে কয়েকটি তথ্য জানা গেছে। যেমন— তিনি এক সময় জানতে পেরেছিলেন, থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অফিসার্স মেসের একটি কক্ষে তাকে রাখা হয়েছে। যে কক্ষটিতে তাকে রাখা হয়েছিল, সে কক্ষের প্রতিটি জানালা লাল রং দিয়ে এমনভাবে রঙিন করা হয়েছিল যে, দিন না রাত তার কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। জানালাগুলো দিনের বেলায়ও খোলা হতো না। পরিবর্তে সবসময় বৈদ্যুতিক লাইট জ্বালিয়ে রাখা হতো। কক্ষটিতে দুটি বিছানা ছিল। একটি শেখ মুজিবের জন্য, অন্যটিতে থাকত পিস্তলসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো অফিসার। তারা পালাক্রমে ডিউটি করত, শেখ মুজিবকে পাহারা দিত। শেখ মুজিব জানিয়েছেন, ওই অফিসারদের ওপর হুকুম দেওয়া ছিল, পারিবারিক, রাজনৈতিক, সামরিক কোনো বিষয় নিয়েই তারা আলাপ করতে পারবে না। তারা শুধু আবহাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে হাঁ বা না সূচক উত্তর দিতে পারত। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘কথাবার্তা না বলে দুজন লোক একই কামরায় নীরবে বসে থাকতে হবে। আর অফিসার ভদ্রলোকের কাজ হলো, আমাকে চোখে চোখে রাখা যাতে আমি ভাগতে চেষ্টা না করি বা আত্মহত্যা করতে না পারি।’ (পৃষ্ঠা ২৫৭) এভাবে একটি মাত্র বদ্ধ কক্ষের মধ্যে থাকতে থাকতে শেখ মুজিব অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘আমি সেই অন্ধকার কামরায় বসে বসে খোদাকে ডাকা ছাড়া কি করতে পারি।’ একদিন এক উচ্চপদস্থ অফিসারকে তিনি বলেছিলেন, ‘জানালাটা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। না হলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে কি করে? তিনি জানালা খুলে দিতে হুকুম দিয়ে চলে গেলেন।’ (পৃষ্ঠা ২৫৯) প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ওই অফিসার্স মেসে বন্দি নেতা শেখ মুজিবকে তিন বেলাই রুটি ও গোশত খেতে দেওয়া হতো। তিনি লিখেছেন, ‘যে খাবার দেয় তা খেতে আমার কষ্ট হয়। আমাশয় রোগে অনেকদিন থেকে ভুগছি। রোজ রোজ রুটি ও গোশত খাই কেমন করে? পেটের ব্যথা শুরু হলো। ডাক্তার সাহেবরা আসেন, ঔষধ দেন। কিছুদিন ভালো থাকি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন বললাম, রুটি আমি খেতে পারব না। আমাকে ভাত দেওয়ার বন্দোবস্ত করুন। দু-একদিন পরেই ভাতের বন্দোবস্ত হলো। তবে গোশত চলল।... (অফিসার্স মেসে) সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী— মাছ খেতে পারে না। এইভাবেই দিন চললো। তবে দিনে তিন-চারবার চা খাবার বন্দোবস্ত হয়েছিল।’ (পৃষ্ঠা ২৬৪) বন্দি অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টের দিনগুলো সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘একাকী কামরায় রাতদিন থাকা যে কি ভয়াবহ অবস্থা তা ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না। দিন কাটতে চায় না। বাইরে যেয়ে একটু হাঁটাচলা করবো তারও উপায় নাই। সূর্যের আলো গায়ে স্পর্শ করার উপায় নাই। লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি নিজেরই ধুতে হয়। বিছানা নিজেরই করতে হয়।...’ শেখ মুজিব আরো লিখেছেন, ‘এই কামরাটার খবর ছাড়া কিছুই জানি না। কারো কোনো চিঠি পাই না। রেণু (অর্থাৎ বেগম মুজিব) ছেলেমেয়ে নিয়ে কি অবস্থায় আছে?... এমনিভাবে একাকী দিন কাটছে। কোনো খবর নাই। শরীরও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। একদিন একজন কর্মচারী বলল, দিনভর বসে আর শুয়ে থাকবেন না। ঘরের ভিতর যে জায়গাটুকু আছে সেখানে হাঁটাচলা করুন। কথাটা আমার মনে ধরল। যদিও ছোট্ট কামরা, তিন ঘণ্টা সকালে দুপুরে বিকালে আপন মনে হাঁটতাম। খোদা ছাড়া কেইবা সাহায্য করতে পারে! দেশের কোথায় কি হচ্ছে? দুনিয়ায় কি ঘটছে? কোনো কিছুর খবর নাই। কাগজ পড়া নিষেধ। রেডিও শুনতে পারবো না। কারো সাথে কথা নাই। দিন কাটাও।’ (পৃষ্ঠা ২৬৪) এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর বন্দি নেতা শেখ মুজিবকে সন্ধ্যার পর মেস এলাকার বাইরে একটা রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু তার আগে সব আলো নিভিয়ে ফেলা হতো। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘একজন অফিসার আমার সাথে হাঁটতো। আর দুজন মিলিটারি রাস্তার দুইদিকে পাহারা দিত। কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারতো না। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতো।’ এসব কারণে শেখ মুজিবের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘কয়েকদিন বেড়াবার পর আমার একটু সন্দেহ হলো। মেস এরিয়ার মধ্যে এত জায়গা থাকতে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেওয়া হচ্ছে কেন? দু-একজনের ভাবসাবও ভালো মনে হচ্ছিল না। একটা খবরও আমি পেলাম। কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করছে আমাকে হত্যা করতে। আমাকে পিছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তারপর বলা হবে, পালাতে চেষ্টা করেছিলাম, তাই পাহারাদার গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো জায়গাটা মেসের বাইরে। জনসাধারণ বা অন্য কাউকে দেখাতে পারবে যে, আমি ভেগে বাইরে চলে গিয়েছিলাম তাই গুলি করা হয়েছে।...’ (পৃষ্ঠা ২৬৫) এরপরই শেখ মুজিব জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আর মেস এলাকার বাইরে বেড়াতে যাবেন না। হাঁটাহাঁটি তিনি মেস এলাকার ভেতরেই করবেন। নিজে না বললেও ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, তিনি হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তারাও তাই তাকে বাধা দেয়নি। প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা দরকার, একই আগরতলা (ষড়যন্ত্র) মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পালানোর কথিত চেষ্টাকালে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তার সঙ্গে গুলিতে আহত হয়েছিলেন আরেক সার্জেন্ট ফজলুল হক। এই অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, শেখ মুজিবের সন্দেহ অমূলক ছিল না। সময় ও সুযোগ বুঝে তাকে আসলেও হত্যা করে বলা হতো, তিনি পালানোর চেষ্টা করেছিলেন বলেই গুলি করতে হয়েছে! বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাবহুল ইতিকথা দু-এক লেখায় সমাপ্যের বিষয় নয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ-পর্বেও শেষ করা গেল না। আগামীতেও এ বিষয়ে লেখার ইচ্ছা রইল। লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১