আপডেট : ১১ February ২০১৯
পাখি প্রকৃতির অলঙ্কার। সৌন্দর্যের প্রতীক। প্রকৃতি ও মানুষের বন্ধু। এক দিকে পাখি যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে অন্যদিকে পরাগায়ণে সহায়তা করে খাদ্যের উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বলা হয়ে থাকে একটি দেশের মানুষ কতটা পরিবেশবান্ধব, কতটা মানবিক, তা বোঝা যায় সেই দেশে কত পাখি আছে, পাখিরা কেমন আছে, তা দেখে। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে যে জনপদের মানুষের, তারা সত্যিই ভাগ্যবান। কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে, অতিরিক্ত লাভের আশায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাখি শিকার বা বধ আমাদের দেশে চলছেই। বাংলাদেশে পাখি শিকার বা বাণিজ্যিক উদ্দেশে ধরা নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল, এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে অপরাধীর দুই বছরের জেল, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। আর পাখির প্রতি নির্মম আচরণও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তারপরও পাখি নিধন বা শিকার থামানো যাচ্ছে না। প্রত্যক্ষ শিকারের বিরুদ্ধে অনেকে সোচ্চার হলেও ফসল বা ফল রক্ষার নামে যেসব পাখি নিধন চলছে তা নিয়ে রয়েছে এক ধরনের নির্লিপ্ত ভাব। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, পরোক্ষ পাখি নিধনের নির্মম দৃশ্য। জেলার ভোলাহাটসহ বিভিন্ন স্থানে বরই ফল রক্ষার জন্য ব্যবহূত হচ্ছে কারেন্ট জাল। আর এই জালের ফাঁদে আটকে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে দেশীয় পাখির সঙ্গে অতিথি পাখিও। তবে নির্বিচারে পাখি হত্যার এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে পাখি নিধন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পাখিপ্রেমিকরা। লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাড়ছে বরই বাগানের সংখ্যা। আর এসব বাগানে পাকা বরই খেতে হানা দিচ্ছে পাখি। বরই বাগান পাখির হাত থেকে রক্ষায় চারদিকে উঁচু করে কারেন্ট পেতে দেন বাগান মালিকরা। বাগানের ওপর দিয়ে পাখি উড়ে যাওয়ার সময় অত্যন্ত স্বচ্ছ এ জালে জড়িয়ে আটকা পড়ছে দোয়েল, শালিক, মাছরাঙ্গাসহ নানা ধরনের দেশীয় পাখি। ফাঁদ থেকে ছুটতে না পেরে এক পর্যায়ে অনাহারে, রোদে শুকিয়ে মারা যায় এসব পাখি। একাধিক বরই বাগান মালিকের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানায়, পাখির উপদ্রব থেকে বরই বাঁচাতে কারেন্ট জাল দিয়ে বাগান ঘিরে রাখা হয়েছে। জালে আটকিয়ে পাখি মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করলেও তারা বলছেন, পাখি প্রচুর পরিমাণ বরই খেয়ে ফেলে, এতে তাদের আর্থিক ক্ষতি হয়। ভোলাহাট উপজেলার ফলিমারি এলাকার বাগানের মালিক শরিফুল ইসলাম বলেন, বাগানে কারেন্ট জাল দিয়ে ঘেরা না দিলে ফসল রক্ষা করা যেত না, পাখিই বাগানের অর্ধেক ফল খেয়ে ফেলত। এতে পাখি কিছু মারা পড়ছে, তবে এ ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হব আমি। অল্প দূরের আর একটি বরই বাগানের মালিক কামিরুল বলেন, পাখি প্রচুর পরিমাণ ফল নষ্ট করছে। এ কারণেই জাল দিয়ে ঘেরা। জালে আটকে কিছু পাখি মারা যাচ্ছে, এতে খারাপ লাগছে; কিন্তু কী করব। লাভ করার জন্যই এভাবে জাল দিয়ে ঘের দিতে হচ্ছে। তবে বাগান মালিকদের এমন নিষ্ঠুর কাজে ক্ষুব্ধ পাখিপ্রেমিকরা। তারা বলছেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাখির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এভাবে পাখি নিধন বন্ধে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। আসাদুল হক নামে স্থানীয় এক পাখিপ্রেমিক বললেন, এভাবে কারেন্ট জাল বাগানের চারদিকে ঘিরে রেখেছে। এতে অনেক পাখি মারা যায়। এভাবে প্রতিদিন যদি পাখি মারা যায়, এর প্রতিকার কি হবে না বা কারো নজর কি পড়ে না। স্থানীয় ভোলাহাট মোহবুল্লাহ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আবদুস সাত্তার বলেন, অনেকেই কারেন্ট জাল দিয়ে এভাবে পাখি নিধন করছে, এটি আমাকে পীড়া দেয়। আমি ঘৃণা করি। অবশ্যই এটি রোধ হওয়া দরকার এবং সরকারের যে আইন আছে সেই আইনের প্রয়োগ দরকার। প্রকাশ্যে এমন পাখি নিধন চললেও নীরব স্থানীয় বন বিভাগ। জনবল সঙ্কটের পুরনো অজুহাতে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানালেন ভোলাহাট উপজেলা বন কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজশাহীতে আমাদের বন্যপ্রাণী বিভাগের অফিস রয়েছে। এখানে কোনো অফিস নেই। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে তারা পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। আপনাদের মাধ্যমে এ বিষয়টি (পাখি নিধন) জানতে পারলাম। বন্যপ্রাণী কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করব, তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে এখন সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে। এরমধ্যে দেশীয় বা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করে এ রকম পাখি আছে ৪০০ প্রজাতির। আর ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ২০১৮ সালের জুন মাসে একটি যৌথ জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে দাবি করা হয়, এক বছরে পাখির বিচরণ কমেছে প্রায় ৪০ হাজার। বিশেষ করে উপকূল ও দ্বীপ এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাখি কমেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালে প্রথম যখন পাখি জরিপ করা হয়, তখন পাখি পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৮ লাখ। ২০১৭ সালে পাখি দেখা গেছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩২টি, যা ২০১৮ সালে নেমে এসেছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ২১টিতে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর আরো পাখি কমবে। আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়ের পাশাপাশি ফল ওফসলের চাষের কারণেও এখন মরছে পাখি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক মনিরুল খান বলেন, বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর বেশ কিছু পাখি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সেগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার মতে, এখন প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ এবং পাখি নিধনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা। মনিরুল খান বলেন, আশার কথা হলো, তরুণরা সচেতন হচ্ছে। তারা পাখিপ্রেমিক হয়ে উঠছে। এটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের পাখিবান্ধব একটি সমাজ গড়ে তুলতে হবে।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১