বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১০ February ২০১৯

রাষ্ট্রীয় সম্পদের এত অপচয়!

রাষ্ট্রীয় সম্পদের এত অপচয়! ছবি : বাংলাদেশের খবর


উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। দেশজুড়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রক্রিয়ায় চলছে এই অপচয়। জেলা, উপজেলা, বিভাগ, রাজধানীসহ দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে অপচয় হচ্ছে না। পদ্ধতিগত অপচয়, দুর্ঘটনাজনিত অপচয়সহ কোন কোন খাতে কী পরিমাণ অপচয়, তারও কোনো সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিসাব করলে দেখা যাবে প্রতিবছরের অপচয়ের পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অপচয়ের এই লাগাম টেনে ধরতে পারলে দেশের উন্নতি আরো তর তর করে বেড়ে যেত। কিন্তু তা কেন সম্ভব হচ্ছে না? এই প্রশ্ন সবার।

৬৪ জেলায় সরকারের প্রশাসনিক ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোয় যুগ যুগ ধরে চলছে এই অপচয়। এসব অপচয়ের পেছনে রয়েছে বহুমুখী কারণ। উদ্যোগের অভাব, দাফতরিক সিদ্ধান্তহীনতা, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত না পাওয়া, কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া, দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতিসহ বৈধ ও অবৈধ প্রক্রিয়ায় খোয়া যাওয়া চুরি যাওয়াই অন্যতম কারণ। আবার ব্যবহার আর পরিচর্যার অভাবেও নষ্ট হচ্ছে পরিবহন পুল, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং নৌপরিবহন বিভাগের ভারী ভারী ফেরি ও উন্নয়নযন্ত্র।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দেদার চলছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিবহন, প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার্য আসবাবপত্র, যান্ত্রিক জিনিসপত্রের অপচয় চলছেই। এ ছাড়া পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের বৈধ কিংবা অবৈধ সংযোগ আর জ্বালানি তেলের অপচয়ের স্রোত প্রতিদিনের দৃশ্যমান চিত্র।

আবার সরকারের বড় বড় উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার যান্ত্রিক উন্নয়নসামগ্রী ধ্বংস হচ্ছে সিদ্ধান্তহীনতায় আর চুরিতে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখেও দেখছে না। অপচয়ের কথা স্বীকারও করে না। কেউ কেউ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। ফলে গচ্ছা যাচ্ছে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ সেটা প্রাকৃতিকভাবেই পাওয়া হোক আর মানুষের তৈরি করা সম্পদই হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সচেতনতা জরুরি। ব্যবহারে আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। তবে সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

কেউ অবৈধভাবে ব্যবহার করে অপচয় করছেন। কেউ মূল্য পরিশোধ করেও অপচয় করছেন। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও নানা সীমাবদ্ধতা আর উদাসীনতায় বন্ধ করা যাচ্ছে না এই অপচয়।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল বিভিন্ন মাধ্যমে সীমিত আকারে অপচয় রোধের প্রচার করে দায় সারছে।

তবে সূত্রগুলো বলছে, অপচয় ও অবৈধ সংযোগ ঠেকাতে গ্যাস-পানি-বিদ্যুতে মিটার পদ্ধতি চালুর প্রক্রিয়া চলছে। এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে অপচয় অনেকটা কমে যাবে।

ঢাকাসহ দেশে গ্যাস বিতরণের বড় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এর অবৈধ ব্যবহার ও অপচয়-সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান নেই। নিয়মিতভাবেই অভিযান পরিচালনা করছে সংস্থাটি। একটি হিসাব বলছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসেই কেবল ১৩৪ কিলোমিটার অবৈধ লাইন উচ্ছেদ করা হয়েছে। যাতে প্রায় ৫০ হাজার ৬৪৪টি অবৈধ চুলার গ্যাস সংযোগ বিছিন্ন করা হয়।

তিতাসের সূত্রগুলো বলছে, প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। কিন্তু তিতাসের একটি সংঘবন্ধ চক্র নানা ফায়দা দিয়ে অবৈধ গ্যাস সরবরাহ দেখেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আর এসব সংযোগ থেকে মূল্যবান এই সম্পদ অপচয় হচ্ছে অব্যাহতভাবে। অপ্রয়োজনে গ্যাস জ্বালিয়ে রাখছেন। একটি দিয়াশলাইয়ের খরচ বাঁচাতে দিনের পর দিন গ্যাস নষ্ট করছেন অনেকে।

জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম তৈরি করতে হবে। তাদের নৈতিকতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় কোনো কর্তৃপক্ষ অপচয় ঠেকাতে পারবে না।

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার একটি অপরাধ। আমরা সব সময় বিষয়টি প্রচার করি। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হতে হবে। আবার বৈধ সংযোগ নিয়েও বেশিরভাগ মানুষ গ্যাস নষ্ট করছে। তাদের বাসাবাড়িতে গ্যাসের চুলা সারাক্ষণ জ্বলছে। গ্যাস কতটা মূল্যবান, সেটি বুঝতে হবে।’

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শীতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। এর কারণগুলোর একটি অপচয়। সেটি বৈধ ও অবৈধ দুই ধরনের সংযোগ থেকে হচ্ছে।

পানির ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ঢাকা ওয়াসার একটি হিসাব বলছে, বর্তমানে ২৭ শতাংশ পানি বিভিন্নভাবে অপচয় হচ্ছে। এর পরিমাণ অবশ্য ২০০৮ সালে ছিল ৩৮ শতাংশ। বর্তমানে আবাসিক খাতে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম সাড়ে ১০ টাকা। সে হিসাবে বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার পানি অপচয় হচ্ছে। আর রাজধানীর অভিজাত এলাকায় পানির অপচয় বেশি।

জানা গেছে, বর্তমান সরকারের গত দশ বছরে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা প্রায় ২১ হাজার মেগাওয়াট। আর উৎপাদন হচ্ছে ১২ হাজার মেগাওয়াট। তবে এর মধ্যেও অবৈধ ব্যবহার রয়েছে। এসব বন্ধ করা গেলে বিদ্যুৎ খাতে উন্নতির সুফল আরো বেশি পাবেন সাধারণ মানুষ। বিদ্যুতের অপচয় রোধ করতে এরই মধ্যে প্রিপেইড মিটার সংযোগ কার্যক্রম চলছে। সারা দেশে একযোগে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই এত সস্তায় পানি মিলে না। আমাদের নানা কারণে দাম সমন্বয় করতে সময় লাগছে। দাম বাড়লে মানুষের মধ্যে একটি সচেতনতা তৈরি হবে। আর মিটার পদ্ধতি চালু করা গেলে অপচয় আরো নিশ্চিত করা যাবে। তারপরও অপচয় রোধে দরকার সচেতনতা।’

এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘হিসাব করলে দেখা যাবে প্রতিটি মানুষই দিনে কয়েক লিটার পানি অপচয় করছে। সেটি বৈধ সংযোগ থেকে হোক আর অবৈধ সংযোগ থেকে হোক। রাজধানীর তেজকুনীপাড়ার বাসিন্দা সানজিদা খানম বলেন, ‘এটা ঠিক, আমরা গ্যাস, পানি কিংবা বিদ্যুতের অপচয় করছি প্রতিনিয়ত। এসব ব্যবহারে সতর্ক হলে জাতীয় সম্পদ রক্ষা হবে। অনেক সময় আমরা মনে করে থাকি, দাম পরিশোধ করছি, নিজের অর্থ যাচ্ছে। তবে অর্থ পরিশোধ করলেও জাতীয় সম্পদের অপচয় করা ঠিক নয়।

জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান এ ব্যাপারে বলেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের উন্নয়ন কার্যক্রমের ধরন প্রায় একই। ফলে এখন একটি প্রকল্প বা জোনাল অফিসের যন্ত্রপাতি দিয়ে আরেক প্রকল্পের কিংবা জোনের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। ফলে মেশিনারিজগুলো ব্যবহার শেষে সেটি পুনরায় ব্যবহার হচ্ছে না সেটি বলা যাবে না। তবে কেবল ব্যবহারের অনুপযোগী হলে সেটি বাদ দেওয়া হয়।

এই কর্মকর্তা আরো বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয়ভাবে এবং শহরে কারিগরি ব্যবস্থা কার্যক্রমের আওতায় মেশিনারিজ সংস্কার করে ব্যবহার হচ্ছে। তারপরও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পেলে আমরা সেটি খতিয়ে দেখব।

অন্যদিকে সরকারি যানবাহন অধিদফতরের পরিচালক শাহজাহান আলী বলেন, আমাদের সচল কোনো পরিবহন বসে থাকে না। অর্থাৎ ফিটনেস আছে যেসব গাড়ি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। ফিটনেস শেষ হয়ে গেলে তা নির্ধারিত প্রক্রিয়া শেষে দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই সরকারি প্রক্রিয়া রক্ষা করে আমাদের সব কাজ করতে হয়। এ জন্য কিছুটা সময় লাগতে পারে। যানবাহন ব্যবস্থাপনায় অপচয় প্রশ্নে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১