আপডেট : ০৬ February ২০১৯
ঘোড়াশালের পাটকলের নিরীহ ও নিরপরাধ শ্রমিক জাহালমকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানোর ঘটনায় এবার থলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে। নেপথ্যের সংঘবদ্ধ চক্রকে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে দুদক। জাহালমকে কেন ৩ বছর কারাভোগ করতে হলো এবং এর নেপথ্যের চক্রের হোতাদের চিহ্নিত করে আগামী ২০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ। কোনো মামলার চার্জশিটে নাম না থাকলেও শুধু জাতীয় পরিচয় জালিয়াতির শিকার হয়ে জাহালমকে ৩ বছর কারাভোগ করতে হয়েছে। নেপথ্যের কাহিনী এবং এর সঙ্গে জড়িত চক্রকে শনাক্ত করতে মাঠে নেমেছে জেলা জজ পদমর্যাদায় দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল) আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কমিটির এক সদস্য বাংলাদেশের খবরকে বলেন, নিরপরাধ জাহালমকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে। জাহালমের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতারক চক্রের সদস্য আবু সালেক জালিয়াতি করেছে, যাতে ঘটনা ফাঁস হলে নিজে ধরা না পড়ে। জাহালমের কারাভোগের নেপথ্যে কয়েক বছর আগে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এরপর সালেককে তলব করে দুদক চিঠি দিলে সেটি পৌঁছায় জাহালমের টাঙ্গাইলের বাড়ির ঠিকানায়। নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলের শ্রমিক জাহালম সে সময় দুদকে গিয়ে বলেন, আমি একজন সাধারণ শ্রমিক। আমার নামে সোনালী ব্যাংকে কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হোল্ডার হিসেবে যে ছবি রয়েছে সেটিও আমার নয়। কিন্তু সেদিন জাহালমের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। দুদকে উপস্থিত ব্যাংকের কর্মকর্তারা জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোড়াশাল থেকে জাহালমকে গ্রেফতার করে দুদক। উপায়ন্তর না দেখে তার বড় ভাই শাহানূর মিয়া গত বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে যান। তার আবেদনে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে জাহালমের সঙ্গে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে আবু সালেক আর জাহালম একই ব্যক্তি নন। সম্প্রতি বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ জাহালমকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে মুক্তির আদেশ দেন। প্রতারক চক্রকে এড়িয়ে যায় তদন্তকারীরা ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় আবু সালেক ছাড়াও গোলাম মর্তুজা নামে আরো একজনের জড়িত থাকার কথা বেরিয়ে আসছে। এছাড়া ২৬টি মামলায় সোনালী ব্যাংকের বিভিন্ন ধাপের কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে। কিন্তু সংঘবদ্ধ চক্রের হোতাদের কৌশলে এড়িয়ে গেছে দুদকের তদন্ত কমিটি। তারা আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে গোলাম মর্তুজা ও আবু সালেকের কোনো ‘অস্তিত্ব’ পায়নি বলে দাবি করে। অথচ ৩৩ চেকের মাধ্যমে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎকারী ব্যাংক হিসাব ও প্রতিষ্ঠান মেহেরুন সামাদ ট্রেডার্সের প্রোপ্রাইটর হচ্ছে গোলাম মর্তুজা। তার বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা সদরের দক্ষিণপাড়ায়। সে মৃত ছামাদ মোল্লার ছেলে। মর্তুজার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তার স্ত্রী কালনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। তার বড় ভাই মৃত তবিবুর রহমান রুনু ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। চক্রের অপর সদস্য আবু সালেকের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। আবু সালেক মূলত নির্বাচন কমিশনের ভোটার আইডি কার্ড প্রস্তুত প্রকল্পে কাজ করত। সেখান থেকেই সে ভোটার আইডি কার্ডে ছবি পরিবর্তন করে কৌশলে নিজেই জাহালম বনে যায়। ফাঁসিয়ে দেয় একজন পাটকল শ্রমিককে। কিন্তু দুদকের ২৬ মামলার ৯ তদন্তকারী কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে জাহালম পরিচয়ধারী আবু সালেক থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তদন্তকারীরা ঘটনাটি বের করতে পারেনি নাকি সূক্ষ্মভাবে তা এড়িয়ে গেছে- সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, জাহালম যেখানে বাংলাতেই ভালোভাবে স্বাক্ষর করতে জানেন না সেখানে চেকে স্বাক্ষর রয়েছে ইংরেজিতে। এছাড়া এ মামলায় গ্রেফতারকৃত অপর আসামি ব্যাংক কর্মকর্তা নজরুলও সালেকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার কথা স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত এই নজরুলের স্বীকারোক্তি ধরে এগোলে সালেককে খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল। কিন্তু দুদক বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যায়। গত তিন বছর ধরে প্রকৃত আসামির বিষয়ে বেশ কিছু ক্লু মিললেও অজ্ঞাত কারণে উদাসীন ছিল দুদক। ফলে প্রকৃত অপরাধী বহাল তবিয়তে থেকেছে আর হতভাগা জাহালমের জুটেছে তিন বছরের কারাবাস। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমাদের দেশেই এটা সম্ভব। এখানে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে অনায়াসে পার পাওয়া যায়। এটাকে কোনো গাফিলতি বলে আমি মনে করছি না। টাকা আত্মসাৎকারী সিন্ডিকেটের হাত অনেক লম্বা। যে কারণে একজন নিরীহ ও নিরপরাধ জাহালমকে তিন বছর জেলের ঘানি টানতে হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হস্তক্ষেপ না করলে এ ঘটনা সবার অগোচরেই রয়ে যেত এবং বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে বেড়াত। তিনি আরো বলেন, শুধু মর্তুজা বা সালেক নয়- এর পেছনে ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং দুদকের কেউ জড়িত আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। অন্তত একটি ঘটনা স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় এনে দুদক প্রমাণ দিক এটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তির দায় বহন করে না। সে যেই হোক, অপরাধ করে বা দায়িত্বে অবহেলা করে পার পাওয়া যায় না এই নজির স্থাপন করবে- এটাই দুদকের কাছে মানুষের প্রত্যাশা।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১