বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৫ February ২০১৯

প্রয়োজন মেহনতি ও সংবেদনশীলদের ঐক্য


২০১৮ সালে এসে মানুষের উদ্ভাবনক্ষমতার আবারো প্রমাণ পাওয়া গেল নিরাপদ সড়কের জন্য কিশোরদের আন্দোলনে। পুলিশ যা পারেনি, তারা সেটাই করে ফেলেছিল। বদলে দিচ্ছিল ট্রাফিকের দৃশ্য। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে সড়কে মানুষের নিরাপত্তাহীনতার পেছনকার কারণ উদ্ঘাটন। তারা জানাল কারণ অন্যকিছু নয়, কারণ স্বয়ং রাষ্ট্র। প্ল্যাকার্ডে তারা লিখে দিয়েছিল, ‘রাষ্ট্রের মেরামত চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।’ রাষ্ট্রই যে দায়ী এই সত্যটাকে তারা কেমন করে চিনল? কই বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীরা তো চিনতে পারেননি। তারা নানা কথা বলেছেন, আসল কথা না বলে। এর দায়িত্ব, ওর ব্যর্থতা, এসব বললেন, বলতেই থাকলেন এবং বলতে থাকবেনও। কিন্তু বলতে পারলেন না মূল ত্রুটিটা কোথায়। বলতে পারলেন না যে ব্যর্থতা রাষ্ট্রের।

কিশোররা বলতে পেরেছে, কারণ তাদের দৃষ্টি সরল ও স্বচ্ছ। আসল সত্যটা দেখতে তাদের কষ্ট হয়নি এবং যা দেখেছে তা বলতে তারা ভয় পায়নি। অবিকল রূপকথার সেই শিশুটির মতো, যে বলে ফেলেছিল, ‘রাজার গায়ে তো কোনো জামাকাপড় নেই।’

রূপকথাটি হয়তো অনেকেরই মনে আছে। লিখেছেন হ্যানস ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন। দেড়শ বছর আগে লেখা, কিন্তু এখনো জনপ্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক। দেশের রাজাটি ছিলেন ভীষণ দাম্ভিক, তার খেয়াল ছিল ঘণ্টায় ঘণ্টায় পোশাক বদলানোর। নতুন নতুন পোশাক, চমকপ্রদ পোশাক তার চাই-ই চাই। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন তিনি ড্রেসিং রুমে। খবর পেয়ে বিদেশ থেকে দুজন অতিশয় শেয়ানা ঠগ এসেছিল সেই দেশে। তারা বলল রাজার জন্য এমন সুন্দর ও সূক্ষ্ম পোশাক তৈরি করে দেবে যেমনটা কেউ কখনো দেখেনি। তবে মাকড়সার জালের চেয়েও হালকা এই পোশাক দুই ধরনের লোক দেখতে পাবে না। এক. যারা নিজেদের পদমর্যাদার অযোগ্য; দুই. যারা নির্বোধ।

অভিনব পোশাকের সন্ধান পেয়ে রাজা ভীষণ খুশি। ঠগেরা কাজ শুরু করল। রাতদিন তারা তাঁত চালায়, কিন্তু পোশাক বোনে না। ভান করে শূন্য তাঁতে অদৃশ্য কাপড় বোনার। টাকা নেয় হাতিয়ে, দামি সিল্ক ও সুতা নেয় চেয়ে; সব ভরে রাখে নিজেদের থলেতে। রাজা তার সবচেয়ে প্রবীণ ও বিজ্ঞ মন্ত্রীকে পাঠালেন, কাজ কেমন চলছে দেখতে। তিনি গিয়ে দেখেন তাঁত শূন্য। দেখে ভয় পেয়ে গেলেন, তাহলে কি তিনি অযোগ্য বা নির্বোধ? সে জন্যই কি দেখতে পাচ্ছেন না? ভয়ে ভয়ে তিনি পোশাকের রঙ, কারুকাজ, নকশা, সবকিছুরই প্রশংসা করে প্রায় পালিয়েই এলেন। গেল অন্য রাজকর্মচারী। তাদেরও ওই একই দশা। এলো সেই দিন যখন রাজা নতুন পোশাক পরে রাজপথে যাবেন, শোভাযাত্রা সহকারে। রাজা এবং তার পারিষদ সবাই এসে দেখেন তাঁত শূন্য। কিন্তু ভয়ে তাঁরা বলতে পারলেন না যে কোনো পোশাক দেখতে পাচ্ছেন না। ঠগেরা ভান করল পোশাক দেখানোর। বলল, মহারাজ আপনি তাহলে আপনার গায়ের জামাকাপড় সব খুলে ফেলুন, এই পোশাকে আপনাকে আমরাই সাজিয়ে দি। রাজা তার জামাকাপড় খুললেন, ঠগেরা ভান করল খুব যত্ন সহকারে তাকে সুসজ্জিত করার। আয়নায় রাজা নিজেকে দেখেন, দেখে চমকে ওঠেন। কিন্তু কিছু বলতে সাহস পান না; পাছে লোকে ভাবে তিনি রাজা হওয়ার একেবারে অযোগ্য কিংবা নিতান্ত নির্বোধ। শুরু হলো রাজ শোভাযাত্রা। রাজার মাথার ওপরে চাঁদোয়া, তার গায়ে আঙখাব যার প্রান্ত ধরে হাঁটছে পারিষদরা। তিনি চলেছেন হেঁটে। আসলে কিন্তু কিছুই নেই, সবটাই কাল্পনিক। সদল বলে রাজা চলেছেন সদম্ভে। রাস্তায় যারা দাঁড়ানো, জানালা দিয়ে যারা দেখছে সবাই বলছে, ‘আহা, রাজার নতুন পোশাক কী মনোহর! কী সুন্দর তাকে মানিয়েছে।’ সকলেরই ভয় নির্বোধ বা অযোগ্য বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার। একটি শিশু হঠাৎ বলে উঠেছে, ‘আরে, রাজার গায়ে তো কোনো কাপড় নেই!’ শিশুর সন্ত্রস্ত পিতা সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের মুখ চেপে ধরেছে। কিন্তু ততক্ষণে ছড়িয়ে গেছে আওয়াজটা যে রাজার গায়ে কোনো কাপড় নেই। এরপর সারা শহর চিৎকার করে উঠেছে, ‘রাজার গায়ে কোনো কাপড় নেই।’ রাজার সন্দেহ হয়েছে যে, লোকে যা বলছে সেটাই ঠিক; কিন্তু তাই বলে তিনি তো আর স্বীকার করতে পারেন না যে তাকে বোকা বানানো হয়েছে। বস্ত্রহীন মহারাজ তাই আগের চেয়েও অধিক দম্ভে এগিয়ে চললেন। পারিষদ দল চলল তার পেছনে পেছনে। থলেতে ভরে টাকাপয়সা, রেশমি পশমি সুতো নিয়ে ঠগেরা তো ততক্ষণে পগার পার।

রূপকথাতেও সত্য থাকে বৈকি! নইলে তারা টিকবে কেন? এই বিশেষ রূপকার সত্যটা তো অনেক দেশেই ভীষণ রকমের সত্য। রাজা-মহারাজাদের আড়ম্বর, হুমকি-ধমকি যে নির্বোধের অহমিকা মাত্র সেটা এখন ধরা পড়ে গেছে; কিন্তু তবু তাদের সমর্থকরাও আছে যারা রাজাদের পিছু পিছু হাঁটে, নির্বুদ্ধিতা ঢাকতে গিয়ে নিজেদের যারা আরো বেশি নির্বোধ বলে প্রমাণ করে দেয়, তবে কিছুতেই স্বীকার করে না যে তারা নির্বোধ। নইলে রাজারা এখনো টিকে থাকে কী করে? রাজারা নিজেরাও প্রতারক। মস্ত মস্ত একেকজন। যা তারা নয় তার ভান করে, প্রজাদের ঠকায়। প্রজারাও ঠকায় নিজেদেরকে এবং একে অপরকে। রাজ্যজুড়ে মাসতুতো ভাইদের কাজ-কারবার। রাজা যায় রাজা আসে; কিন্তু রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা টিকে থাকে। ওদিকে রাজাকে ঠকিয়ে ধনদৌলত নিয়ে চম্পট দেয় বিদেশি ঠগেরা। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই হলে ঠগে ঠগে মাসতুতো ভাই হতে অসুবিধাটা কোথায়? ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হওয়ার জোগাড় হয়। পশম ছাড়া কী কম্বল সম্ভব?

রাজার জায়গায় রাষ্ট্র গড়লে পুঁজিবাদী বিশ্বের বর্তমান অবস্থাটা বেশ পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। ভেতরে ভেতরে রাষ্ট্রের বড় কর্তারা সবাই বিলক্ষণ দিগম্বর অবস্থাতেই রয়েছেন। ধরা যে পড়ছেন না তার কারণ তাদের গুণাবলি নয়, কারণ হচ্ছে দর্শকদের ভয়। শাসকেরা শাসিতদের ভীতসন্ত্রস্ত রাখেন। তাদের দখলে আছে প্রচারের যন্ত্র। যেগুলো তাদের গুণগান করতে থাকে। সার কথাটা হলো এই যে, ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার, নইলে মানুষের মুক্তি নাই। কিন্তু তার জন্য প্রথমে দরকার রাষ্ট্রের চরিত্রটা শনাক্ত করা। সেই কাজটা তারা করবে না বিদ্যমান ব্যবস্থার যারা সুবিধাভোগী। পারবে তারাই যারা সুবিধালোভী নয়, যারা ভয় পায় না সত্য কথা বলতে। রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই দরকার পড়বে রাষ্ট্রের স্বভাব-চরিত্রে পরিবর্তনকামীদের ঐক্য। এই ঐক্যের কথা নজরুল বলেছেন, বলেছেন রবীন্দ্রনাথও। নজরুলের বয়স যখন চব্বিশও হয়নি, তখন তিনি সম্পূর্ণ স্বউদ্যোগে অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন, ধূমকেতু নামে। সেটা ১৯২২ সালের কথা। প্রায় একশ বছর আগের ব্যাপার। রাজনৈতিক নেতারা তখন স্বরাজ চাই স্বরাজ চাই বলে চেঁচামেচি করছেন। নজরুল বলেছেন স্বরাজ-টরাজ বুঝি না। ওসব কথায় ফাঁকি আছে; পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। সেকথা অন্যরা তখন বলত না। স্বাধীনতা মানে কী, সেটা পরিষ্কার করে দিয়ে কবি বলেছেন, স্বাধীনতা অর্থ দেশের এক ইঞ্চি জমিও ইংরেজের অধীনে না-থাকা।

ওই ধূমকেতু পত্রিকাতেই তার নিকটতম বন্ধু ও সহযোদ্ধা মুজফফর আহমদ চিঠির আকারে প্রবন্ধ লিখে জানিয়েছেন যে স্বাধীনতাও যথেষ্ট নয়, চাই মুক্তি। আর মুক্তি মানে হলো পুঁজির শাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা। পরে তারা উভয়েই যুক্ত হয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে। নজরুল কবিতা লিখেছেন ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’ নাম দিয়ে। ধূমকেতুর পরে বের করেছেন লাঙল, তার পরে গণবাণী। ডাক দিয়েছেন মেহনতি মানুষের ঐক্যের। ডাকটা রবীন্দ্রনাথও দিয়েছেন; নজরুলেরও আগে, অবশ্য কিছুটা ভিন্নভাবে। ১৮৯৩ সালে লেখা ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় নিজেকে সম্বোধন করে কবি বলছেন, পলাতক-বালকের মতো গাছের ছায়ায় দুপুরবেলাতে বাঁশি বাজিয়ে গান গেয়ে সময় কাটালে আর চলবে না। জেগে উঠতে হবে।

অত্যাচারী ভীষণ ভয় পায় অত্যাচারিতের ঐক্যকে। তাই তো দেখি আমাদের দেশের শাসকশ্রেণি কীভাবে সকল পেশার মানুষকে বিভক্ত ও পরস্পর-বিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এমনকি যে মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে অভিন্ন লক্ষ্যে একসঙ্গে লড়েছেন, তাদেরকেও পরস্পরবিরোধী শিবিরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকরা যে ঐক্যবদ্ধ হবেন সে সুযোগটাও রাখা হয়নি। শাসকরা শ্রমিকদের বঞ্চিত করেছে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে, ছাত্রদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে ছাত্র সংসদে মিলিত হওয়ার সুযোগ। অবদমিত করেছে সেই শক্তিকে, মুক্ত হলে যা অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বদলে দিতে পারত। দারিদ্র্যের জায়গায় নিয়ে আসতে পারত প্রাচুর্য। রাষ্ট্রের শাসক রাজা-মহারাজারা এসব করেছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। আজ তাই প্রয়োজন মেহনতিদের ও সংবেদনশীলদের ঐক্য। নিজেদের সুবিধা বাড়ানোর জন্য নয়, ব্যবস্থা বদলানোর জন্য। ব্যক্তিমালিকানার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জায়গায় সামাজিক মালিকানার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতায়।

সে ঐক্য গড়ে উঠলে, একত্রে দাঁড়ায় যদি সবে, তাহলে মায়ের কান্না, মাসির দরদ, ঠগ-জোচ্চরের প্রতারণা, মালিকদের দম্ভ, সবকিছুই অপসৃয়মাণ স্মৃতি হয়ে দাঁড়াবে। অহঙ্কারী রাজা তখন কী করবে? কী আর করবে? পালাবে! ভয়ে। দেখবে যে সে ধরা পড়ে গেছে, কেবল যে অত্যাচারী হিসেবে তা নয়, প্রতারক হিসেবেও। প্রমাণ হবে যে রাজাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রতারক; কোনো মাসিই তার সমান নয়, ঠগ-জোচ্চরেরাই তার কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ।

রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটি পেয়েছি; সেই সঙ্গীতে বিশেষভাবেই রয়েছে মায়ের মলিন বদন দেখে নয়নজলে ভাসার কথা; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মায়ের সন্তানদের একত্রে দাঁড়ানোার জন্য যে ডাক দিয়ে গেছেন সেটা যেন না-ভুলি। একত্রে দাঁড়ালে তবেই মাতৃভূমির মুক্তি ঘটবে, নইলে নয়। জরিপ বলছে বাংলাদেশে শিশুরা এখন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কানে খাটো, বয়স্করাই বা কি পারছে নিজেদের কান সজাগ রাখতে? তবু একত্রে দাঁড়ানোর ওই ডাকটা পৌঁছে দেওয়া চাই। ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া পরিত্রাণের অন্য কোনো উপায় নেই খোলা। আমরা যে বাঁচতে চাই।

 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১