বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০২ February ২০১৯

হারিয়ে যাওয়া শৈশবের দিনগুলো


শৈশব! ছিল না কোনো বালাই। ছিল না কোনো গণ্ডি। দুরন্তপনার ক্ষেত্র ছিল অবারিত। মধ্যে চলে গেছে অনেকগুলো বছর। সেই সময়ের শিশুদের শৈশব আর এ সময়ের শিশুদের শৈশবের ঢের পার্থক্য। আধুনিক যুগে শহুরে শিশুদের শৈশব যেন খাঁচায় থাকা ছটফটে চড়ুই পাখির মতো। প্রাণ আছে কিন্তু সেই প্রাণে আনন্দের লেশ নেই।

সেই অতীতে আমাদের শৈশবে সবার কাছে নিজের স্কুলটি ছিল সবচাইতে প্রিয় জায়গা। তখন এখনকার মতো এত স্কুল ছিল না। গ্রামে কিংবা শহরে সরকারি স্কুলগুলোতেই সবাই পড়ত। সকালে চোখে ঘুম নিয়ে রেডি হতে হতো। ব্যাগে থাকত পড়ার বইয়ের সঙ্গে কমিক বই। আরো থাকত পাঁচ-ছয়টি করে কলম। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে সর্বোচ্চ দুইয়ের বেশি কলম থাকে না। হিসাবেও তাই ঠিক। তাহলে ওই পাঁচটি কলম নেওয়ার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল।

সরকারি স্কুলের বিশাল মাঠ। বিদ্যালয়ের সবচেয়ে রাগী শিক্ষক পিটি স্যার। হাতে তার জালি বেত। মারলে লাগত বেজায়। তাই সকালের শুরুতেই পিটিতে কেউ মার খেতে চাইত না। পিটি শেষে যে যার ক্লাসে চলে যেত। নিয়মিত প্রতি ক্লাসে স্যাররা আসতেন। পড়া না পারলেই মার। সেই বেতের বাড়িতে যেন একটা মায়া থাকত। ঠিকই স্যার পড়াটা আবার বুঝিয়ে দিতেন সবাইকে।

অনেকের কাছে ক্লাস দীর্ঘ লাগত। মনে হতো কখন যে টিফিন হবে! ভাবতে ভাবতে টিফিনের বেল। অনেকেই টিফিন খেতো বাটারবন, ক্রিমরোল। এখন বাটারবন দেখা গেলেও দু-একটি দোকান ছাড়া ক্রিমরোলের দেখা পাওয়া যায় না। অনেকে গেটে থাকা দারোয়ান মামাকে পাঠাতো। দারোয়ান মামা ঝালমুড়ি এনে দিত। গেটের বাইরে ফুসকা বিক্রি হতো। ছোটদের বাইরে যাওয়া নিষেধ হলেও বড়রা ঠিকই দারোয়ান মামাকে পটিয়ে বাইরে থেকে ফুসকা খেয়ে আসত। গরমের সময় মালাই আইসক্রিম বিক্রি হতো। ১ টাকা, ২ টাকা করে।

অনেকে আবার খাওয়া বাদ দিয়ে টিফিন সময়ে মাঠে খেলায় ব্যস্ত। ছেলেরা বল দিয়ে ফুটবল খেলায় ব্যস্ত। অন্যদিকে ক্লাসরুমেও কলম ফাইট, কাটাকাটি, বাক্স খেলা। শুধু কলম দিয়ে কাটাকাটি খেলার জন্যই একেকজন এতগুলো কলম নিয়ে আসত। অনেকেই ব্যস্ত কমিক বই পরিবর্তনে। সে সময় কাগজের কমিক বই ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। চাচা চৌধুরী আর সাবু, দ্যা অ্যাডভেঞ্চার অব টিনটিন, বিল্লু কমিকস পড়ে অনেকেই টিনটিন, বিল্লু ভাবত নিজেকে।

মেয়েরা পছন্দ করত পিংকি কমিকস। বড় ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, কুয়াশা পড়ত। সে সময় সেবা প্রকাশনীর এ বইগুলোতে যেন প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। ক্লাসে বন্ধুরা একজন আরেকজনকে তিন গোয়েন্দার নাম অনুসারে কিশোর, মুসা, রবিন বলে ডাকত। এভাবে এক ক্লাসে অনেকগুলো কিশোর, মুসা, রবিন হয়ে যেত। ক্লাসের বিশিষ্ট ভালো ছাত্রছাত্রীরা আবার এসব পড়ত না। তারা পড়ত জাফর ইকবালের সায়েন্সফিকশন বই। সরকারি স্কুলগুলোতে মাঝে মাঝে মিটিং হতো। এ সুযোগে স্কুল আগে ছুটি হলে সবাই আনন্দ করত। ছুটি শেষে সবাই বাসায়। কেউ কেউ বিকেলে প্রাইভেট পড়ত। হাতে গোনা কোচিং সেন্টার ছিল। তবে বেশিরভাগই বাসায় পড়ত। বিকেলে বাইরে গিয়ে আবার খেলা। এর মধ্যে বাড়ির কাজ শেষ করে ফেলত অনেকে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসা।

পড়া শেষে রাত ৯টার অপেক্ষা। কখন শুরু হবে! ম্যাকগাইভার, ডিএটিম, সিন্দবাদ। ম্যাকগাইভারের মতো অনেকে হতে চেষ্টা করত। মীনা কার্টুনের গানটি মুখস্থ ছিল না এমন কিশোর-কিশোরী খুঁজে পাওয়া কষ্ট ছিল। আমি বাবা-মায়ের শত আদরের... দারুণ একটা গান। রাত ১০টা বাজলেই ঘুম। কাউকে বলতে হতো না। অনেকে আবার রাতের পড়া শেষে গল্পের বই পড়ত। ছেলেমেয়েরা ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনত আবার ক্যাসেট প্লেয়ারের ফিতা দিয়ে মজার খেলাও খেলত।

সে সময়টায় এখনকার মতো এত চকোলেট, ক্যান্ডি ছিল না। ছিল নাবিস্কো লজেন্স। সবচেয়ে ভালোর মধ্যে ছিল ডেইরি মিল্ক মিমি। চিপসের মধ্যে ছিল পটেটো, মি. টুইস্ট।

শীতকালে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে সবাই নানাবাড়িতে যেত, পিঠা-পায়েশ খেতো, খুব মজা করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পার হয়েছে অনেকগুলো বছর। আমূল পরিবর্তন হয়েছে সবকিছুই।

এখনকার সময়ের শৈশব পুরোটাই আগের সময়ের থেকে আলাদা। শহরে সকালে যে ছেলে বা মেয়ে ঘুম থেকে ওঠে, তার ওপর থাকে বিশাল দায়িত্ব। সকালে ফ্রেশ হয়েই রুটিন অনুসারে একগাদা বই গোছানো। আবার সেই বইয়ের বেজায় ওজন। ছোট ছোট শিশুরা সেই ব্যাগের ভারেই নুইয়ে পড়ে। ওদেরও করার কিছুই নেই। বই সব নিয়ে গেলে স্যার-ম্যাডাম খুশি হবেন। শুধু বই নয়, সঙ্গে ইয়া মোটা মোটা গাইড বই। স্কুলে যাওয়ার জন্য এখন আর হাঁটতে হয় না। এখন সবখানেই স্কুল। অনেকে আবার গাড়ি ব্যবহার করে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন। স্কুলের পড়া শেষ করে আবার ফ্ল্যাট বাসায়। গোসল করে খেতে খেতে কোচিংয়ের সময় হয়ে যায়। তাদের ছুটতে হয় কোচিংয়ের পানে। এখানেই কি শেষ! তা নয়।

বাসায় আসার পর প্রাইভেট টিচার। শেষ পর্যন্ত নিজের পড়ার সময় বের করতেই কঠিন হয়ে যায়। এর মধ্যে ফুরসত পেলে ট্যাবে গেম খেলা। অনেকে আবার প্লে স্টেশনে গেম খেলে। ওই সুউচ্চ চার দেয়ালের জেলখানা। যেখানে সাধারণ জীবনের আওয়াজ যায় খুব কম। শিশুটি শৈশব থেকে এভাবেই বেড়ে ওঠে। মনে করে এটাই হয়তো ছোট থেকে বড় হওয়ার আধুনিক সিস্টেম। বাবা-মা যে যার মতো চাকরি করে বাসায় এসে ক্লান্ত। সন্তানের সঙ্গে তেমন একটা বোঝাপড়া হয়ে ওঠে না। গতানুগতিক বন্ধু বা বান্ধবীর জন্মদিন হলে যাওয়া। কেক কাটা, ছবি তোলা।

বার্ষিক পরীক্ষা শেষ তো নতুন ক্লাসে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং শুরু করা। দম ফেলার কোনো সময় নেই। মানসিক বিকাশের কোনো সুযোগ নেই। অনেক সময় দেখা যায় এসব শিশু বাইরের কোনো মানুষের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতেও পারে না। একধরনের সংকোচবোধ কাজ করে। প্রযুক্তির ছোবলে সুবিধার পাশাপাশি তাদের শৈশবকে তছনছ করে দিচ্ছে।

এখনকার শিশুদের শৈশব কাল্পনিক, মোহময় এবং আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় বেশ উচ্চতর মাপের। সে সময়ের শৈশবটা ছিল মনের আনন্দে ভরপুর আর এখন হচ্ছে ভার্চুয়াল সৌন্দর্যে ভরপুর। এ কারণে বয়স ১০ না হতেই চোখে চশমা চলে আসে।

এখন সবই আছে কিন্তু কোনো কিছুতেই আনন্দ নেই। শিশুদের শৈশব যেন এক যান্ত্রিক রোবটের মতো। চলছে তো চলছেই। অভ্যস্তও হয়ে গেছে ওরা। হতেই তো হবে। করার যে কিছুই নেই!


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১