আপডেট : ২৫ January ২০১৯
ত্রুটিযুক্ত পরিকল্পনা আর অদক্ষতার কারণে গচ্চা গেল সরকারের ১০ কোটি টাকা। উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন প্রকল্পে ব্যয় হওয়া এই অথ বিফলে গেল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এসব ইউটার্নকে যানজট নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় হিসেবে দেখিয়েছিল। প্রকল্প গ্রহণের আগে কয়েকবার হয়েছে মূল্যায়ন সভা। তখনো ত্রুটি ধরা পড়েনি। প্রকল্পে ১০ কোটি টাকা খরচ করার পর নতুন করে মূল্যায়ন হয়েছে এই ইউটার্নে কোনো কাজ হবে না। ফলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে এই প্রকল্পের অসম্পন্ন কাজ। ঘটনাটি জানার পর নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বলেছেন, সরকারি অর্থের এমন অপচয় গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এই প্রকল্প অনুমোদন করেছেন এর দায় তাদেরই নিতে হবে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক জানিয়েছেন, ‘পরিবহনের কৌশলগত পরিকল্পনার সঙ্গে এই প্রকল্প সাংঘর্ষিক ছিল তাই আমি এই প্রকল্প গ্রহণকালেই নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু জনতুষ্টির জন্য এই প্রকল্প গৃহিত হয়’। ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক একে যানজট নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে বর্ণনা করে গাজীপুর থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত ২২টি ইউটার্ন নির্মাণের কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত আব্দুল্লাপুর থেকে ১১টি নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। উত্তরার রাজলক্ষ্মী, র্যাব-১ এর প্রধান কার্যালয়ের পাশে এবং কাউলায় তিনটি ইউটার্নের আংশিক কাজ শেষ হয়েছে। তবে ওই এলাকার পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করে আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউটার্ন নির্মাণে ২০১৫ সালের শেষ দিকে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠায়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও অনুমোদন পেতেই চলে যায় দীর্ঘ সময়। কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের জুন মাসে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ডিএনসিসি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কথা বললেও এখনো পর্যন্ত এর অনুমোদন মেলেনি। তিনটি প্রকল্পের শুরু হলেও বাকিগুলোর কাজই শুরু হয়নি। অথচ এরই মধ্যে ৩০ শতাংশেরও কম কাজ করে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। ঢাকা উত্তরের ইউটার্ন প্রকল্পের এসব ত্রুটির বিষয় প্রকাশ্যে আসলে গণমাধ্যমকর্মীরা যোগাযোগ করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই বর্তমানে ইউটার্নের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। কাজে বিআরটি (র্যাপিড বাস ট্রানজিট) বাস্তবায়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে মন্ত্রণালয়। তবে ঠিক কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আলোচনা চলছে, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিআরটি বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়ার পরে আর ইউটার্নের কোনো কাজ নেই। এরই মধ্যে যে কয়টি ইউটার্ন করা হয়েছে, সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। কাজের বিষয়ে আর অগ্রসর না হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিআরটি প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কায়সার হামিদ বলেছেন, ‘২০১৬ আর ২০১৯-এর বাস্তবতা এক নয়। সে সময়কার বাস্তবতায় ইউটার্নের প্রয়োজন থাকলেও বিআরটি বাস্তবায়নের পরে এটার আর প্রয়োজন পড়বে না। তাই ইউটার্ন করা হলেও বিআরটি বাস্তবায়নের পর তা অবশ্যই সরিয়ে নিতে হবে।’ প্রকল্পের পরিচালক মাহবুব আলম বলেন, এ সংক্রান্ত বিষয়ে মিটিংয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও পরিকল্পনা কমিশনকে অবহিত করা হয়েছে। এরপরও উল্লেখ করার মতো সাড়া মিলছে না এ বিষয়ে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক আবারো বলেন, ‘প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে আমি এ প্রকল্প যেন না নেওয়া হয়, তার জন্য অনেকবার বারণ করেছিলাম। তিনি শোনেননি। তার আশপাশে থাকা লোকদের ধারণাপ্রসূত চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে। তারা আসলে নানাভাবে মেয়রকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, ইউটার্ন হলেই ঢাকার যানজট নিরসন হয়ে যাবে।’ ‘শুধু ইউটার্নের ক্ষেত্রেই নয়। রাজধানীর উন্নয়নের নামে এ রকম আরো অনেক প্রকল্পই গ্রহণ করা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে অপ্রয়োজনীয় ও অবাস্তব বলে মনে হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কাজে নেমে হতাশ হওয়ার চেয়ে কাজের আগে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে।’ আরেক নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে সমন্বয়ের চরম অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। যারা এমন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন, এর দায়ভার তাদেরই নিতে হবে।’ ‘ইউটার্ন যেকোনো কাজে আসবে না- এমন কোনো কথা বলা ঠিক হবে না। তবে এটা করতে হবে স্থান ও পরিস্থিতি বুঝে।’ নগর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই সম্ভাবনা যাচাই-বাছাই করেই করা উচিত। কিন্তু আমাদের এখানে সমন্বয়ের বিষয়টি ঠিকভাবে করা হয় না বলেই এমন ঘটনা ঘটছে। তারা বলেন, ঢাকার যানবাহন চলাচলের বিষয়ে এসটিপিতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। সেখানে বিআরটি, এমআরটির বিষয়ে বলা হলেও কোথাও ইউটার্নের বিষয়ে কিছুই বলা নেই। তারপরও ধারণাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যে কারণেই এই পরিণতি। সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উত্তরার রাজলক্ষ্মী, উত্তরা র্যাব-১ কার্যালয় সংলগ্ন জায়গা, কাউলা ছাড়াও উত্তরার জসিম উদ্দিন, জোয়ার সাহারায় গলফ ক্লাব, বনানী-কাকলী মোড়, বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি, ফিলিং একাডেমি, মহাখালী ফ্লাইওভার, মহাখালী বাস টার্মিনাল ও সাত রাস্তা মোড়ে এসব ইউটার্ন হওয়ার কথা ছিল। ওইসব এলাকার স্থানীয়রা বলছেন, ‘এমন অপরিণত চিন্তার প্রকল্প গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ অপচয়ের কোনো অধিকার তাদের নেই। যারা এসবের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে সরকারি অর্থ অপচয়ের এই বেহিসাবি কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে না।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১