বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৩ January ২০১৯

ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে গণসচেতনতা প্রয়োজন


যে বয়স বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে হেসে-খেলে স্কুলে কাটানোর কথা, জীবিকার তাগিদে আজ সে বয়সে কোমলমতি শিশুরা মুখোমুখি হচ্ছে কঠিন বাস্তবতার! যে বয়সে হাতে থাকার কথা বই-কলম ইত্যাদি অথচ আজ সেই বয়সেই তারা হাতে তুলে নিচ্ছে কঠোর শ্রমের হাতিয়ার। নিজের কিংবা পরিবারের দু’মুঠো অন্ন জোগাতে এ শিশুরা যোগ দিচ্ছে বিভিন্ন পেশায়। এদের মধ্যে অনেক শিশুই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়  নিয়োজিত। শিশুশ্রম নিরসনে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ।

বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ ধরনের কাজ করে শিশুরা। এসবের মধ্যে ৪৫টির বেশি কাজই হচ্ছে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। শ্রমিকের বৃহৎ একটি অংশ হচ্ছে পথশিশু। বেঁচে থাকার তাগিদে এরা নিজেদের শ্রম বিভিন্নভাবে বিক্রি করে থাকে। দেশের বিভিন্ন মাছের আড়তে মাছের ভাড় শ্রমিক, ওয়ার্কশপের হেলপার বা কারিগর, মিস্ত্রি, মাটিকাটা, রিকশা চালানো, গাড়ির হেলপার, ঠেলাগাড়ি-ভ্যানগাড়ি চালানো, হোটেলবয়সহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে কোমলমতি শিশু-কিশোররা। বাংলাদেশে ২০ লাখ গৃহ শ্রমিকের মধ্যে ৯৩ শতাংশই হচ্ছে অর্থাৎ ১৮ লাখ ৬০ হাজার শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে। এসব গৃহশ্রমিক মানসিক, শারীরিক, মৌখিক, যৌন নির্যাতন ও আর্থিক শোষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

পথশিশুদের বৃহৎ অংশ বিভিন্ন অপরাধ কর্মে জড়িয়ে যায়। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দ্বিগুণ। শহরে কাজ করে থাকে ১৮ লাখ ও গ্রামে ৬৭ লাখ শিশু শ্রমিক। এসব শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৪৭ লাখ শিশু ঝুঁকির্পূণ পেশায় নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও আইএলও’র জরিপ মতে, কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে ৪৫ ধরনের। তার মধ্যে শিশুরা ৪১টি কাজে অংশগ্রহণ করে। যারা গৃহ পরিচারিকার কাজ করছে, তাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে গৃহপরিচারিকার ৮৬ শতাংশ মেয়ে। ৩০ শতাংশের বয়স ৬ থেকে ১১ বছর আর বাকিদের বয়স ১২ থেকে ১৬ পর্যন্ত। এরা প্রতিদিন ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করে থাকে।

শিশুশ্রম বন্ধের জন্য মূলত প্রয়োজন গণসচেতনতা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। শিশু শ্রমিকরা অনেকাংশে বেশি সময় কাজ করে থাকলেও সে অনুযায়ী তারা তাদের শ্রমের ন্যায্য দাম পায় না। কাজের চাপ থাকে প্রচুর; অথচ ঠিকমতো খেতে পারে না! গৃহকর্ত্রীর ছেলেমেয়েরা রোজ ঠিকই স্কুলে যাওয়া-আসা করে কিন্তু কখনো চিন্তা করেনি কাজের মেয়েটির কথা। অনেক সময় কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে নীরবে কান্না করে থাকে কিশোরীরা। গৃহকর্ত্রীর চোখ রাঙানিতে কাজের মেয়েরা অনেক সময় প্রতিবাদ করতে চাইলে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মারধর বা নানা রকমের অত্যাচার করে থাকে। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও হাত তোলে এসব অসহায় শিশু শ্রমজীবীদের কোমল শরীরে। অনেক সময় জানা যায় গৃহকর্ত্রীর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয় কোমলমতি শিশুরা। অনেক কিশোরী মানুষের বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় বাড়ির কর্তা কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়; প্রতিবাদ করার মতো ভাষা বা সুযোগ পায় না তারা। জাতীয় শিশু নীতি ২০১১-এর ৮ এর ৮.৯ উপধারায় বলা হয়, যে সকল প্রতিষ্ঠানে শিশুরা নিয়োজিত আছে, সেখানে শিশুরা যেন কোনরূপ শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এর ভিন্ন চিত্র। নিজেদের সন্তানকেই দেখেন স্নেহ-মায়া-মমতার দৃষ্টিতে আর কাজের মেয়েটির প্রতি যত্ন নেওয়া তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে ধমকের সাথে কথা বলেন। গৃহকর্ত্রীর অধিকাংশই তাদের প্রতি বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে থাকেন। কেউ দৈহিক নির্যাতন করে আবার কেউ কেউ করে মানসিক কিংবা যৌন নির্যাতন। কাজের মেয়েটি নীরবে সহ্য করে থাকে; কারণ সে অপারগ, ছায়াবিহীন।

সব শিশুশ্রম বন্ধের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগ। সারা দেশের মতো চিটাগং রেলওয়ে এলাকায়ও রয়েছে শিশু কুলিদের ছড়াছড়ি। এই পেশায় যুক্ত হওয়ার ফলে এদের মন-মানসিকতার বিকাশ হয় না; বরং কুসঙ্গে থাকার ফলে এরা বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ বা অপরাধচক্রে জড়িয়ে যায়। সিগারেট, ইয়াবা ও নানা ধরনের মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবনে এসব শিশু শ্রমিক অল্প বয়সেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কাজের মন্দা হলে এরাই বিভিন্ন অপরাধ করে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের মধ্যে অন্যতম হলো ‘ওয়েল্ডিং’য়ের কাজ। ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করতে গিয়ে অনেক শিশু চোখে আঘাত পেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। অসুস্থ হয়ে পড়লে এদের কোনো খোঁজখবর নেয় না মালিকপক্ষ! চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, অদূর ভবিষ্যতে দেশের শিশুশ্রম কমিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন সুনির্দিষ্টভাবে আইনের প্রয়োগ ও কঠোর শাস্তির বিধান, যাতে যারা শিশু শ্রমিক নিযুক্ত করে তারা যেন কিছুতেই মুক্তি না পায়।

চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় কিন্তু শিশুশ্রম সমস্যার সমাধানে নেই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯)-এ স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো বাংলাদেশ। ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করা হয় বটে কিন্তু আদৌ কি সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের দেশে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আছে কি? শুধু গ্রাম বা চট্টগ্রাম শহর নয়, ঢাকাসহ সারা দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। দেশের শ্রম আইনকে বৃদ্ধ আঙুল দেখিয়ে দিব্যি বেড়েই চলছে শিশুশ্রম। শিশুশ্রম নিবারণ করতে হলে প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ আর সমাজের সর্বস্তরে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। তবেই শিশুশ্রম বন্ধ হবে। শিশুদের হাতেই জাতির উন্নয়ন সম্ভাবনার চাবিকাঠি। তাই শিশুদের গড়ে তুলতে হবে আমাদেরই। শিশুরা জাতির সেরা সম্পদ, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা শিশু, আগামীকাল হবে তারাই দেশগড়ার সৈনিক। শিশুকে তার প্রাপ্য পূর্ণ অধিকার দিয়ে গড়ে তুলতে পারলেই সার্থক হবে বাংলাদেশ।

 

লেখক : সাংবাদিক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১