বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৫ January ২০১৯

উপকূলের মাটিতে লবণাক্ততা এবং জীববৈচিত্র্যের সঙ্কট


জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন ঘন নোনা পানির প্লাবন মাটিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দিচ্ছে। লবণাক্ততার প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য জেলায় চাষাবাদে সমস্যা, সুপেয় পানির সঙ্কট ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমিতে ফলন কম হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় উপকূল অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করে। এ ছাড়া নিরুপায় হয়ে লবণ পানি খাওয়ার কারণে শরীরে চুলকানি, চর্মরোগসহ নানাবিধ অসুখ দেখা দিচ্ছে। মূলত ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলার পর থেকে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অনেকে দীর্ঘদিনের পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক পরিবার প্রতিকূল পরিবেশের অভিযোজনে টিকতে না পেরে বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে বা বিক্রি করে দূরে পাড়ি জমাচ্ছেন (বিশেষ করে শহরে চলে যাচ্ছেন)। সহজ কথায়, লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ এখন কর্মহীন বাস্তবতার মুখোমুখি। জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় বা বিভিন্ন কারণে ফসলি জমি কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন কাঁকড়া ও চিংড়ি চাষে ঝুঁকছেন। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ পরিসংখ্যান জরিপে দেখা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে গত দুই বছর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে স্থান বদল হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের। ধারণা করা হচ্ছে, এই অভ্যন্তরীণ অভিবাসনে দক্ষিণাঞ্চল থেকে মানুষ উল্লেখযোগ্য হারে স্থান বদল করেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে অভিবাসনের হার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কেননা সবশেষ আদমশুমারি মতে, দেশে এখন গড় বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। কিন্তু খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের নিচে। আবার সারা দেশে প্রতি বছর যেখানে গড়ে ২ শতাংশ হারে দারিদ্র্যের হার কমছে, সেখানে দক্ষিণের জেলাগুলোতে কমেছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপকূলের নদী-খালে লবণপানি বেড়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে উপকূলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি এক গবেষণার তথ্যমতে, সুন্দরবনের শিবসা, পশুর নদসহ অন্যান্য নদ-নদী ও খালে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। তথ্যমতে, সুন্দরবন এলাকায় প্রতি বছর লবণাক্ততা বাড়ছে প্রায় ২ পিপিটি বা পার্টস পার ট্রিলিয়ন হারে। লবণাক্ততার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়েছে মিঠাপানির মাছের ওপর। ইতোমধ্যে খুলনা ও বাগেরহাটের নদী-নালা-খাল-বিল থেকে মিঠা বা স্বাদু পানির অনেক মাছ হারিয়ে গেছে। সুন্দরবন ও চারপাশের এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ যত বাড়বে, বনের প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। নদ-নদীগুলোর প্রবাহ কমে আসার ফলে নিম্নমুখিতার দিকে লবণাক্ততা উঠে আসছে। লবণপানি আটকে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করার ফলেও লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে।

সুন্দরবনকে সুন্দরবনের মতো থাকতে দেওয়া হচ্ছে না! বনের চারপাশে নতুন নতুন বসতি ও আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। পর্যটকের ভারে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আবার কারখানার দূষণে শুধু উদ্ভিদ-প্রাণীই ঝুঁকিতে নেই, বিভিন্ন প্রাণীর স্বাভাবিক খাদ্যচক্র নষ্ট হচ্ছে। সুন্দরবনে নদী-খালগুলো নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীর এক অনন্য ভান্ডার। কিন্তু বিভিন্নভাবে সুন্দরবনের এই নদী-খালগুলোকে বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছে। নদী-খালের মুখ বন্ধ করে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে মাছ ধরা হচ্ছে! সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে নদী-খাল আর জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সুন্দরবন ও আশপাশের পরিবেশের ওপর লবণাক্ততার প্রভাব এবং প্রকৃতি-প্রতিবেশবিনাশী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে বনের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। সুন্দরবনে প্রায় ১৬৭ প্রজাতির বেশি উদ্ভিদ-প্রাণী রয়েছে। সুন্দরবন প্রাকৃতিক সম্পদের আধার ও জলবায়ু দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চলের রক্ষাদেয়াল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সমগ্র দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশসহ উপকূলের লক্ষ-কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের সঙ্গে জড়িত। সুন্দরবন অক্সিজেনেরও বিশাল আধার। সুন্দরবনের গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। তবে সুন্দরবন রক্ষায় আসলে কি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে? এখনই উদ্যোগ না নিলে লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবনে ডলফিনসহ অনেক জলজ প্রাণী টিকে থাকতে পারবে না সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা প্রতি বছর কমছে। আবাসস্থল ও খাদ্য সঙ্কটসহ চোরা শিকারিদের কারণে বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত শৌর্য, বীর্য আর বীরত্বের প্রতীক বাঘ রক্ষা করতে না পারলে সুন্দরবন বাঁচানো যাবে না। তথ্য মতে, প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজারের বেশি হরিণ নিধন করা হয়। বন রক্ষার স্বার্থে বাঘ ও হরিণ রক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ভুগতে থাকা প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামহীন উন্নয়ন ও অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশকে নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি দায়ী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। এছাড়া জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা নিতে হবে। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী বাড়াতে হবে। সুতরাং আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উপকূলে লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ সুন্দরবনের আশপাশ থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পকারখানা সরিয়ে ফেলতে হবে।

 

লেখক : সাবেক ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫—মসধরষ.পড়স


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১