আপডেট : ১৩ December ২০১৮
ডেন্টাল প্লাকের ভেতরে বাস করে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া যদি কোনোভাবে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, তাহলে সৃষ্টি হয় নানা জটিলতার। উপরন্তু একটি স্থায়ী দাঁত পড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ হলো ডেন্টাল প্লাক। গবেষকরা বলেছেন, প্লাক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে রক্তনালির প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ফলে হূদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। সঠিক সময়ে চিকিৎসার মাধ্যমে এই প্রদাহ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বা ডেন্টাল প্লাক দূর করা যায়। আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব রোগী আগে মাড়ির রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ৬৪ শতাংশ বেশি। বর্তমানে ডেন্টাল সার্জনরা নিখুঁত চিকিৎসার জন্য ডেন্টাল প্লাক দূরীকরণে অত্যাধুনিক আলট্রাসনিক স্কেলার ব্যবহার করেন, যেটা পানি ও তরঙ্গের মাধ্যমে কাজ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব প্রবীণ নিয়মিত দাঁতের প্লাক (খাদ্যকণা ও ব্যাকটেরিয়া) দূরীকরণের চিকিৎসা নেন, তারা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের জটিলতায় কম ভোগেন। এই গবেষণাটি করা হয় তাইওয়ানের পঞ্চাশোর্ধ্ব ২২ হাজার রোগীর ওপর। গবেষকরা বলেছেন, যেসব রোগী তাদের দাঁত সঠিকভাবে স্কেলিং করান, তারা পরবর্তী সাত বছর হূদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো রোগ থেকে ঝুঁকিমুক্ত থাকেন। দন্ত চিকিৎসকরা স্কেলিংয়ের মাধ্যমে দাঁতের ওপর থেকে এবং মাড়ির পকেট থেকে প্লাকসমূহ দূর করেন। যখন দাঁতের চারপাশের টিস্যুগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখনই একজন রোগী পেরিওডেন্টাল রোগে আক্রান্ত হন। দুর্ভাগ্যবশত মাড়ির ক্ষয়ই হচ্ছে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দাঁত পড়ে যাওয়ার প্রথম কারণ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব লোকেরাই মাড়ির রোগে আক্রান্ত হন। মাড়ির এ ধরনের রোগ মুখের ভেতরের হাড়ের কাঠামোকে ধ্বংস করে। এর ফলে কখনো কখনো হাড় প্রতিস্থাপনও করতে হয়। মাড়ির ভেতরে খাদ্যকণা জমে থেকে যে আবরণ তৈরি করে, তার নাম ডেন্টাল প্লাক। এই ডেন্টাল প্লাক ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে পাথরের মতো অবস্থায় যখন থাকে, তখন দেখা দেয় নানা সমস্যা। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মাড়ির প্রদাহ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ। এই পেরিওডেন্টাল ডিজিজ বা মাড়ির রোগকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগটিকে বলা হয় জিনজিভাইটিজ। এ অবস্থায় মাড়িতে প্রদাহ হয় এবং সামান্য আঘাতেই মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে, কখনো দেখা যায় দাঁত ব্রাশের সময় বা শক্ত আপেল বা পেয়ারা জাতীয় ফল খেলেও মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়। কখনো বা ঘুম থেকে উঠলে দেখা যায় বালিশে রক্ত অথবা মুখের ভেতরে রক্ত জমাট হয়ে আছে। এ অবস্থায় চিকিৎসা না হলে প্রদাহ আরো গভীরে যায়। কারণ জমে থাকা পাথর বা ডেন্টাল প্লাক তখন দাঁতের পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অংশ যেমন পেরিওডেন্টাল মেমব্রেন ও এলভিওলার বোন নামক পাতলা হাড়কে আক্রমণ করে। ফলে ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় প্রদাহ মাড়িতে আরো গভীরে যায় এবং পকেট তৈরি হয়। দাঁত তার অবস্থান থেকে নড়ে যায়। ফলে দাঁত ফেলে দিতে হয়। নতুবা চিকিৎসা ব্যবস্থা জটিল হয়। সাধারণত পেরিওডেন্টাইটিস রোগ দীর্ঘস্থায়ী হলে দাঁতের পার্শ্ববর্তী চোয়ালের হাড়ের ক্ষয় হয় এবং সে ক্ষেত্রেই দাঁত নড়ে যায়। এই রোগে মুখে দুর্গন্ধ হয়, মাড়ি ফুলে যায়, মাড়ি থেকে পুঁজ ও রক্ত বের হয়। আলট্রাসোনিক স্কেলিংয়ের সাহায্যে দাঁতের ময়লা বা ডেন্টাল প্লাক পরিষ্কার করা হয়। প্রথমে মুখের ইনফেকশন কমিয়ে তারপর মাড়ির চিকিৎসা করা হয়। এক্ষেত্রে একটি ওপিজি এক্সরে করে বুঝতে হয় কী মাত্রার হাড় ক্ষয় হয়েছে। মাড়ির বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে নড়ে যাওয়া দাঁতকে আবার সঠিকভাবে রাখা যায়। এই আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা এখন আমাদের দেশেও হচ্ছে। মাড়ির বা পেরিওডেন্টাল রোগের চিকিৎসা : (সার্জিক্যাল ) সার্জিক্যাল পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘পকেট রিডাকশন সার্জারি’ যা ফ্ল্যাপ সার্জারি নামেও পরিচিত। এই পদ্ধতির মাধ্যমে দাঁতের মাড়ি এবং দাঁতের মাঝখানের দূরত্ব কমে যায়। ফলে ওই অংশে ব্যাকটেরিয়ার বসতি কমে যায়। যেসব রোগীর দাঁতের মাড়ি একদমই পাতলা অথবা সম্পূর্ণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত, তাদের ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতিটি সবচেয়ে উপকারী। আধুনিক অনেক ধরনের গবেষণায় দেখা গেছে, মাড়ির রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মাড়িতে প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং সেই প্রদাহ বা ইনফেকশন দেহে রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে শরীরের প্রধান প্রধান অঙ্গ যেমন হূৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, লিভার, কিডনি, হাড় এমনকি গর্ভবতী নারী, শিশুকেও আক্রান্ত করতে পারে। অতএব মাড়ির রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ডেন্টাল প্লাক অথবা দাঁতের ও মাড়ির ফাঁকে লেগে থাকা খাদ্যকণা দূর করা বা পরিষ্কার রাখা। সবচেয়ে বড় কথা, ডেন্টাল প্লাকমুক্ত থাকা মানে জীবন রক্ষা করা। চিকিৎসা ১. প্রথমেই ইতিহাস থেকে জানতে হবে তার অসুবিধা ও অন্যান্য তথ্য। ২. ডেন্টাল এক্সরে ওপিজি এবং বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে প্রদাহের মাত্রা অন্যান্য রোগের উপস্থিতি ও পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে। ৩. স্থানীয় পর্যায়ে মাড়ির শল্য চিকিৎসা ও ডেন্টাল স্কেলিংয়ের মাধ্যমে দাঁতের গোড়া থেকে পাথর দূুর করে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ৪. অন্যান্য পর্যায়ে যদি ডায়াবেটিস থাকে বা অন্যান্য রোগের উপস্থিতি থাকে, তবে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে, যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা এবং চিকিৎসার আগে অ্যান্টিবায়োটিক কভারেজ দেওয়া। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বলেছেন, প্রত্যেকেরই বছরে অন্তত একবার, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের বছরে অন্তত দুবার মাড়ি ও দাঁতের চিকিৎসা নিতে হবে। এতে করে হূদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিও যেমন কমবে, তেমনি ভালো থাকবে মুখের স্বাস্থ্য, নিশ্চিত হবে দেহের স্বাস্থ্য। অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১