আপডেট : ১২ December ২০১৮
আখকে বলা হয় বীমাকৃত ফসল। কেননা আখ বাংলাদেশের একমাত্র কৃষি পণ্য, যা সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরাসরি কৃষক চিনিকলে সরবরাহ করতে পারেন এবং যার মূল্য রূপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আখচাষিকে প্রদান করা হয়। আখ বিক্রির জন্য এখন কৃষককে আর কারো পিছু পিছু ঘুরতে হয় না, মিলে আসতে হয় না। ডিজিটাল গেজেটের মাধ্যমে চাষিকে সরবরাহের তিন দিন আগে আখ বিক্রির অনুমতিপত্র অর্থাৎ পুর্জি প্রদান করা হয়। ফলে কৃষক সময়মতো শ্রমিক জোগাড় করে আখ কেটে, পরিষ্কার করে ও ছোট ছোট আঁটি বেঁধে নির্ধারিত সময়ে চিনিকলে সরবরাহ করতে পারেন। খরা, বন্যা ও ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে অন্য ফসল বিনষ্ট হলেও আখ একেবার নষ্ট হয় না, কৃষককে প্রতারিত করে না। বৈরী পরিবেশে আখের বেঁচে থাকার ক্ষমতা বেশি। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় উত্তরাঞ্চলের কৃষকের মাঠের সকল ফসল তলিয়ে গেলেও আখ ঠিকই মাথা উঁচু করে বন্যার পানির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিল বীরের মতো। আখ শুধু বন্যার সময়ই নয় খরার সময়ও অনেক দিন সেচবিহীন অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে। আখের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। আখের সবুজ পাতা উত্তম গো-খাদ্য। শুকনা পাতা জ্বালানি ও ঘর ছাওয়ার কাজে ব্যবহার করা যায়। আখের ছোবড়া ও মোথা গ্রামাঞ্চলে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আখ থেকে গুড় তৈরি করা হয়। গুড়ের পুষ্টিগুণ চিনির চেয়ে অনেক বেশি। আখের রস ও সিরাপের প্রচুর চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। চিবিয়ে খেতেও আখের ব্যবহার কম নয়। আখ চাষের অন্যান্য সুবিধা হলো আখের সঙ্গে একাধিক সাথী ফসল চাষ করা যায়। একবার মূল ফসলের চাষ করে একাধিকবার মুড়ি আখের চাষ করা যায়। দানা ফসলের তুলনায় আখ চাষ অধিক লাভজনক। মিল এলাকায় এক একর জমিতে আখ চাষ করে সহজে ৬০০ মণ ফলন পাওয়া যায়, যার বাজার মূল্য ৮৪ হাজার টাকা। উৎপাদন খরচ ৩৪ হাজার টাকা বাদ দিলে, নিট লাভ হয় ৫০ হাজার টাকা, যা অন্য ফসল চাষে সম্ভব নয়। প্রায় প্রতি বছরই চাষিদের স্বার্থে আখের মূল্য বাড়ানো হয়। এজন্য চিনিকল এলাকায় একটি স্লোগান কৃষকের মুখে মুখে শোনা যায়- ‘বৃথা যায় না চাষির ঘাম, আখ লাগালেই বাড়ে দাম’। সরকার চলতি আখ মাড়াই মৌসুমে মিল গেট কেন্দ্রে প্রতিমণ (৪০ কেজি) আখের মূল্য ১২৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকায় এবং বাহিরের কেন্দ্রে ১২২.৩৬ টাকা থেকে ১৩৭.৩৬ টাকায় বৃদ্ধি করেছে। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে আখের মূল্য মণপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আশা করা যায়, এতে মিল এলাকায় আখের আবাদ বৃদ্ধি পাবে এবং বাড়বে আখ সংগ্রহ ও চিনি উৎপাদনের পরিমাণ। এ বছর ১৫টি চিনিকলের চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টন। ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৩৬৮ টন আখ মাড়াই করে শতকরা ৭ দশমিক ৪৩ রিকভারি রেটে এই পরিমাণ চিনি উৎপাদন করা হবে। গত মাড়াই মৌসুমে (২০১৭-১৮) ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৭৩ টন আখ মাড়াই করে শতকরা ৫ দশমিক ৭৭ রিকভারি রেটে ৬৮ হাজার ৫৬২ টন চিনি উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অন্যতম চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে চলতি ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৭০ টন আখ মাড়াই করে শতকরা ৭ দশমিক ৫০ ভাগ রিকভারি রেটে ১৮ হাজার ৬৩৬ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অপরদিকে নাটোর সুগার মিলে চলতি মাড়াই মৌসুমে ৭ দশমিক ৭৫ রিকভারি রেটে ১ লাখ ৫৮ হাজার ১১৭ টন আখ মাড়াই করে ১২ হাজার ২৫৫ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। এ মৌসুমে রাজশাহী চিনিকলে ১ লাখ ২৬ হাজার ৪৯৩ টন আখ মাড়াই করে শতকরা ৭.৫ রিকভারি হারে ৯ হাজার ৪৮৮ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। অন্যদিকে জিলবাংলা সুগার মিলে এ বছর ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৮ টন আখ মাড়াই করে শতকরা ৮ ভাগ রিকভারি রেটে চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ৯ হাজার ৩৯৬ টন। কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে চলতি মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটিতে ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৮ টন আখ মাড়াই করে শতকরা ৭.২৫ ভাগ রিকভারি রেটে ৭ হাজার ৮ হাজার ৫১৬ টন চিনি উৎপাদন হবে। মস্তিষ্কের উপযুক্ত বিকাশ ও পূর্ণ কার্যকারিতার জন্য চিনি ও গুড়ের বিকল্প নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, একজন সুস্থ মানুষের বছরে কমপক্ষে ১৩ কেজি চিনি ও গুড় খাওয়া প্রয়োজন। সে হিসাবে দেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য বার্ষিক ২১ লাখ টন চিনি ও গুড় প্রয়োজন। প্রতিবছর দেশে ৫ থেকে ৬ লাখ টন চিনি ও গুড় উৎপাদিত হয়। বাকি ১৫ টন চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করা হয়। দেশে বর্তমানে ১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৫২ লাখ টন আখ উৎপাদিত হয়। যার হেক্টরপ্রতি ফলন মাত্র ৪৭ টন। সঠিক যত্ন ও আখ চাষের আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি আখের ফলন ৮০ টনে বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীনে ১৫টি চিনিকল রয়েছে। এসব চিনিকলের বার্ষিক চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার টন। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে বছরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টনের বেশি চিনি উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। চিনিকল এলাকায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবৈধভাবে শত শত পাওয়ার ক্রাশারের মাধ্যমে গুড় তৈরি হওয়ার কারণে আখের অভাবে চিনিকলগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। আখ থেকে উৎপাদিত দেশীয় চিনির দামের চেয়ে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ‘র’ সুগার থেকে উৎপাদিত চিনির দাম পড়ে অনেক কম। বর্তমানে সরকারি চিনিকলে প্রতিটন চিনির মিল গেট মূল্য ৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে ‘র’ সুগার থেকে উৎপাদিত প্রতিটন চিনি বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার ৩০০ টাকায়। এ কারণে সরকারি চিনিকলে উৎপাদিত চিনি বিক্রি হচ্ছে না। ফলে মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের বেতনভাতা সময়মতো প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না চিনিকলগুলোর পক্ষে। একই কারণে চিনি উৎপাদন উপকরণ, জ্বালানি তেল, আখ আবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সার ও বালাইনাশক সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে মিলগুলোর পক্ষে। এ ছাড়া অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাচ্ছেন না তাদের গ্র্যাচুইটির পাওনা টাকা-পয়সা। ফলে বৃদ্ধ বয়সে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এ অবস্থার অবসানে সরকারকে আরো সহযোগিতা করতে হবে এবং কৃষকের স্বার্থে মিল-কারখানাগুলো সচল রাখতে করপোরেশন কর্তৃক চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করতে হবে সময়মতো। বর্তমান সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্পের উন্নয়নে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে চিনিশিল্পকে বহুমুখী করার বিভিন্ন উদ্যোগ। সেই সাথে লোকসানও কমে আসতে শুরু করেছে। ২০১৩-১৪ সালে এই শিল্পের নিট লোকসান ছিল ৫৬৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। অন্যদিকে আখ চাষ বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে কয়েক দফা আখের দাম বাড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্পের উন্নয়নে বর্তমান সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা। একটি সুগার রিফাইনারি স্থাপনের মাধ্যমে ‘র’ সুগার থেকে হোয়াইট সুগার উৎপাদন করে দেশের চিনির চাহিদা পূরণ করা। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের এই প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২৪ দশমিক ১৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের পুরনো যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন এবং সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে আরেকটি প্রকল্প। চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেডের আধুনিকায়নের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে বিএমআরআই প্রকল্প। এতে ৭৩ বছরের পুরনো যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চিনিকলটির আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ভোক্তাদের কাছে সহজে দেশে উৎপাদিত গুণগত মানের চিনি পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াসে নেওয়া হয়েছে ১ কেজি ও ২ কেজি ওজনের প্যাকেটজাত চিনি বাজারজাত করার ব্যবস্থা। চিনিকলের প্রেসমাড ও ইথানল প্লান্টের বর্জ্য থেকে সোনার দানা নামে জৈবসার উৎপাদন করা হচ্ছে কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে। অপরদিকে প্রতিটি চিনিকল এলাকায় নিজস্ব খামার ও পতিত জমিতে বিষমুক্ত শাকসবজি ও ফলমূলের চাষ করা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে অচিরেই চিনিশিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন। লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১