বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১০ December ২০১৮

বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন ভুমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধে


বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান সন্দেহাতীতভাবে সবার আগে। বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সবার জানা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল কয়টি? যুদ্ধের সময় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কেমন ছিল? শহীদ হয়েছেন কয়জন? হয়তো অনেকের জানা, অনেকের অজানা। কৌতূহলী সেসব পাঠকের জন্য আজকের এই ফিচার। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সুখি আখতার। 

মুক্তিযুদ্ধে ঢাবি : মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) জন্ম। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও ঢাবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে জন্য পাকিস্তানের আক্রমণও হয় ভয়াবহ। ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় গণহত্যা চালানো হয়। নয় মাসজুড়ে ঢাবি ছিল হুমকির মুখে। ঢাবির অকুতোভয় ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেদিন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। প্রাণপণে রুখেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ। জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। হাসতে হাসতে শহীদ হয়েছেন অনেকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক ও বিভিন্ন পদমর্যাদার অসংখ্য কর্মকতা-কর্মচারী পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছেন। এদের মধ্যে শিক্ষক রয়েছেন ১৯ জন, ছাত্র ১০১ জন, কর্মকর্তা একজন ও কর্মচারী ২৮ জন।

২৫ মার্চ রাতের প্রথমার্ধে ঢাবির বেশ কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হত্যা করে পাকবাহিনী। এরপরেও অনেককে হত্যার চেষ্টা চালায় কিন্তু ব্যর্থ হয়। প্রথমে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, সূর্য সেন হল ও জগন্নাথ হলে আক্রমণ চালায় পাকসেনারা। কলা ভবনের সামনের বটগাছটি উপড়ে ফেলে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আগুন দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র পুড়িয়ে দেয়। সামরিক বাহিনী জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়েছিল কিন্তু ক্লাসে আসেনি ছাত্রছাত্রীরা। শিক্ষকরা ক্লাস নিতে আসতেন কিন্তু তাদের সবারই সক্রিয় সমর্থন ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। যে কারণে ১৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। আবারো বেশকিছু শিক্ষক নিহত হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে স্থাপন করা হয়েছে নামফলক ও স্মৃতিস্তম্ভ। এসব তৈরিতে সময় লেগেছে ২৪ বছর। কালো কঠিন গ্রানাইড পাথরের ওপর জ্বলজ্বল করছে ঢাবির সাথে সংশ্লিষ্ট ১৯৫ শহীদের নাম। কলা ভবনের মূল ফটকের সামনে রয়েছে শহীদ ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীদের একটি নামফলক। মধুর ক্যান্টিনের সামনে মধুদার স্মৃতি ভাস্কর্য। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে শহীদ স্মৃতিসৌধ বেদি। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গেটে আছে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।

শহীদ প্রথম বুদ্ধিজীবী রাবি‘র : মুক্তিযুদ্ধের ১৮ বছর আগে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। ছাত্রদের রক্ষা করতে পাকসেনাদের বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। তিনিই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ১৩ এপ্রিল। এরপর থেকেই নিখোঁজ হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শহীদ শামসুজ্জোহা হলে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এখানে নানা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হতো বাঙালিদের। এই বর্বরতার চিহ্ন ধারণ করে আছে হলের পেছনের বধ্যভূমিটি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রাবিতে প্রথম শহীদ হন সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল সকালে পাকবাহিনী তাকে হত্যা করে। ১৫ এপ্রিল বিকেলে পাকবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আসলাম ও কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে যায় গণিত বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে। এরপর আর খোঁজ মেলেনি। ২৫ নভেম্বর মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কেবল এই তিন শিক্ষকই নন, মহান মুক্তিযুদ্ধে রাবি হারিয়েছে ১০ জন শিক্ষার্থী, সহায়ক কর্মচারী ৫ জন ও সাধারণ কর্মচারী ১১ জন।  মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’। সংগ্রহশালায় উল্লেখযোগ্য দলিলাদির মধ্যে রয়েছে— শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশিদুল হাসান, সিরাজউদ্দিন হোসেন প্রমুখের রোজনামচা। সে সময়কার মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পোস্টার। রয়েছে রাবি গণকবর থেকে প্রাপ্ত নাম-না-জানা শহীদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রসহ মুক্তিযুদ্ধের আরো স্মারক ও স্মৃতি।

প্রতিরোধে চবি : মুক্তিযুদ্ধের মাত্র পাঁচ বছর আগে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবদান পর্বততুল্য। প্রায় দুইশ জন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরের দিনই ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। গণিত বিভাগের অধ্যাপক মো. ফজলী হোসেন ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব তালুকদারকে সংগঠনের আহ্বায়ক করা হয়। পাকবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সংগঠনটি অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয় ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। নেতৃত্ব দেন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ইনামুল হক। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক, এখলাস উদ্দিন আহমদ ও মিছবাহ উদ্দিন আহমেদের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে মলোটভ ককটেল প্রস্তুতের পরিকল্পনা করা হয়। ৮ মার্চ চবির ছাত্র সংসদের জিএস আবদুর রব ভারতে সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। ১০ মার্চ চাকসু ভিপি মোহাম্মদ ইবরাহিম ও জিএস আবদুর রব সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের অস্ত্র জমা না দেওয়ার আহবান জানান।

অবশেষে আসে সেই কালরাত অপারেশন সার্চলাইটের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাঙালি সেনা ও গ্রামবাসী মিলে ক্যাম্পাস ঘেরাও করে রাখে- ক্যাম্পাস পাকবাহিনী যাতে দখলে নিতে না পারে। ২৬ মার্চ সকালে পাকবাহিনী ক্যাম্পাস দখল করতে আসে। আলাওল হলকে ঘাঁটি করে সংগ্রাম পরিষদ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরি করে। টানা দশ দিন প্রতিরোধের পরে পাকবাহিনীর গোলাবারুদের সামনে পিছু হটতে বাধ্য হয় নিরস্ত্র সংগ্রাম পরিষদ। এরপর টানা নয় মাস চবিতে ঘাঁটি গেড়ে ছিল পাকবাহিনী। পুরো ক্যাম্পাসকে তারা বানিয়েছিল জমপুরী। স্বাধীনতা অর্জনের নয়দিন পর ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাকবাহিনীমুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন ছাত্র, একজন শিক্ষক ও তিনজন কর্মকর্তা-কর্মচারী শহীদ হন। চবির জিএস আবদুর রব প্রথম শহীদ। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতরের কর্মচারী শহীদ মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী চবির বীর সন্তানদের স্মৃতি ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ’।

এসব স্মৃতিস্তম্ভ ও নামফলক চিরদিন দাঁড়িয়ে থাকবে। আর বাঙালি জাতি এদের স্মরণ করবে চিরকাল। শিক্ষার্থীরা মনে রাখবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সেদিনের তরুণরা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১