বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১০ December ২০১৮

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধকতা


কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে এ সময়কাল অবধি নারী-উন্নয়নের ধারাটি যদি লক্ষ করা যায় তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের নারীরা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। উন্নয়নের মূল ধারাতেই ঘটেছে এ অগ্রগতি। তবে যতটা প্রত্যাশিত ছিল, ততটা ঘটেনি। কখনো বিভ্রান্তিকর রাষ্ট্রীয় নীতিমালা গ্রহণ, কখনো নীতিমালা প্রণয়ন বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয়ে সৃষ্টি করেছে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতার। যার সূত্র ধরে নানা কারণে নারী-উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়ছে।

নারী উন্নয়নের বাধার পথে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়, দারিদ্র্যের স্থান তার শীর্ষে। নারী উন্নয়নের প্রধান বাধাই হচ্ছে দরিদ্রতা। নারী উন্নয়নের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি হচ্ছে নারী শিক্ষা ও নারীর প্রশিক্ষণ। শুধু শিক্ষা নয়, দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের নারীরা আরেকটি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে তারা; আর সেটা হলো স্বাস্থ্য। এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক বেশি পিছিয়ে আছে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে নারী উন্নয়নের পথে আরেকটি বড় বাধা। পুরুষতন্ত্র উগ্র হয়ে উঠলেই এ সহিংসা দেখা দেয়। বাংলাদেশের পশ্চাদপদ পুরুষতান্ত্রিক মুসলিম সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি দীর্ঘকাল ধরে অবহেলিত হয়ে আসছে। নারীরা যেমন ঘরে নিরাপদ নয় তেমনি বাইরেও নয়। কারণ নারীর প্রতি সহিংসতার হার বৃদ্ধিসহ নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে উত্ত্যক্তকরণ। এই নিগ্রহের ফলে সমাজে নারীর প্রতি প্রতিনিয়ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। উত্ত্যক্তকরণ বলতে একজন মানুষের প্রতি অপর একজনের অশালীন আচরণ বা অঙ্গভঙ্গিকে বোঝায়। উত্ত্যক্তের ঘটনা সাধারণত রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য স্থানে ঘটে থাকে। উত্ত্যক্তকরণ বিষয়টি আমাদের সমাজে নতুন না হলেও সম্প্রতি এটি বড় ধরনের রূপ ধারণ করেছে। ফলে স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নারীর সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে।

নারী উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার নারীর উন্নয়নে গুরুত্বকে কেন্দ্র করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। রাজনীতি, খেলাধুলা, কৃষি, শিক্ষা, করপোরেশন, শোবিজ- সবখানে নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। খেলাধুলার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ২০০৬ সালে প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় নারী দল গঠনের পর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের সঙ্গে খেলা হয়। ২০১৪-২০১৭ সালে বাংলাদেশ নারী ফুটবলের অনেক অর্জন রয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দল সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়। এর আগে ভারতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল রানারআপ হয়। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ৫৪ হাজার জনবলের ২৮ হাজার নারী। তৃণমূল পর্যায়ে ২৩ হাজার পরিবার পরিকল্পনা সহকারী এবং সাড়ে ৪ হাজার পরিদর্শিকা নিরাপদ প্রসবসেবা নিশ্চিতের জন্য কাজ করছেন। আইএলও (ILO) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে ৭৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৯২ লাখ নারীই কৃষিকাজ, মৎস্যচাষ ও সামাজিক বনায়নের সাথে জড়িত। তাছাড়া বাংলাদেশ নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, জাতীয় সংসদে নির্বাচিত ২২ জন নারী সাংসদ রয়েছেন। নারীদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। প্রতি উপজেলায় একজন করে নারী ভাইস চেয়ারম্যান এবং সংরক্ষিত আসনে তিনজন করে সদস্য রয়েছেন। আমাদের দেশের নারীরা বাসাবাড়িতে রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালনসহ গৃহস্থালির কাজকর্ম করেন যার স্বীকৃতি জিডিপিতে নেই। এই শ্রমের আর্থিক মূল্যমানও নির্ধারণ করা হয় না। নারীরা দৈনিক গড়ে ১৬ ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজ করেন, যার জন্য কোনো মজুরি তারা পান না। তারা সব মিলিয়ে প্রতিবছর ৭৭ কোটি ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। এতে এ কাজের মোট অর্থমূল্য হয় ৬ হাজার ৯৮১ কোটি থেকে ৯ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। এই অর্থ যদি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যুক্ত করা হতো, তাহলে এর আকার দ্বিগুণেরও বেশি হতো। বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা রয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ৮০ শতাংশের বেশি নারী। সুতরাং বাংলাদেশ নারীর উন্নয়ন ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে তা বলতে কোনো সন্দেহ নেই।

নারী উন্নয়নের মাঝেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে নারী শিকার হচ্ছে নানান ধরনের বাধার। নারী পাচার, পতিতাবৃত্তি, নারীর শোষণ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ও সমাজ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নারীরা। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ এখনো নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিষয়ে তেমন একটা সচেতন নন। শিক্ষার অভাবে অনেক মায়ের মধ্যে এ সচেতনতা তেমন একটা দেখা যায় না। তারা ছেলেদের প্রতি একটু বেশি দুর্বল হয়ে থাকেন। পরিবারে যে কোনো ক্ষেত্রেই ছেলেরা একটু বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এ প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন সামাজিক সংস্কার। মেয়েদের মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। তাদের মেধা, প্রতিভা ও কর্মক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে সব ভালো কাজের। কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে সমান তালে। তাছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর যথাযথ পদক্ষেপ ও সবার সচেতনতার মাধ্যমে এ বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অনেকটা সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১