বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৫ December ২০১৮

ভিকারুননিসা উত্তাল আন্দোলনে ছাত্রীরা

# অধ্যক্ষের ক্ষমা প্রার্থনা # তিন তদন্ত কমিটি # তোপের মুখে শিক্ষামন্ত্রী

ভিকারুননিসা স্কুলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ছবি বাংলাদেশের খবর


মা-বাবার সঙ্গে শিক্ষকের অসদাচরণে অরিত্রীর আত্মহননকে মেনে নিতে পারছে না ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। সকালে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ না দিয়ে তারা বিক্ষোভ করেছে। শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন অভিভাবকরাও। বিক্ষুব্ধদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রধান। স্কুলে আসতে নিষেধ করা হয়েছে মূল ক্যাম্পাসের প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষক জিন্নাত আরাকে। পাঠানো হয়েছে অনির্দিষ্ট কর্মবিরতিতে। এ ছাড়া কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়েও তাকে শোকজ করা হয়েছে।

ভিকারুননিসার ঘটনায় ইতোমধ্যে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসকে বরখাস্ত করা হতে পারে। একই সঙ্গে একজন স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।

আন্দোলন থামছে না ছাত্রীদের। তারা বলছে, বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। মঙ্গলবার দিনভর বিক্ষোভ ও অবস্থান শেষে ছাত্রীরা বিকাল ৫টার দিকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিন বিক্ষোভের সময় তারা স্কুলের সব গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। আজ বুধবার আবারো স্কুলে অবস্থান নেবে তারা। তাদের তিন দফা কর্মসূচির মধ্যে- শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে সুষ্ঠু বিচার না হলে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে ও আজ থেকে ছাত্রীরা পরীক্ষা দেবে না বলে জানিয়েছে।

 

তোপের মুখে শিক্ষামন্ত্রী

শিক্ষার্থী অরিত্রীর আত্মহত্যার পর ওই স্কুলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে গেলে শিক্ষার্থীরা তাকে ঘিরে ধরে। শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন মন্ত্রী। এ সময় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। তারা শিক্ষামন্ত্রীর সামনে ‘বিচার চাই, বিচার চাই’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। প্রিন্সিপালের পদত্যাগ দাবি করতে থাকে। স্কুলে যাওয়ার আগে মন্ত্রী বলেছিলেন, শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তিন সদস্যের একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেছিলেন, অভিভাবকরা মিছিল-টিছিল করছেন, বিষয়টা জটিল হয়ে গেল।

শিক্ষকের কথায় অপমানিত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাকে ‘অত্যন্ত হূদয়বিদারক’ বলে মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী। এ ঘটনায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। নাহিদ বলেছেন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। অভিযোগ ও ক্ষোভের কথা শুনেছি। তাদের বলেছি, কেউ অপরাধী হলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, একজন শিক্ষার্থী কতটা অপমানিত হলে, কতটা কষ্ট পেলে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়? যে ঘটনাগুলো আমরা শুনছি, এর পেছনের কথা শুনছি, ঘটনার পেছনে বা ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভিকারুননিসার শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, স্কুল না নরকশালা! 

‘এই পাগল-ছাগলের বাচ্চা, তোরে যে কইছি তুই শুনছ নাই’- উক্তিটি রাজধানীর খ্যাতনামা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষিকার। সম্প্রতি ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে নোট তুলতে না পারায় দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি এই উক্তি করেন। শিক্ষিকার এমন আচরণে ওই ছাত্রী বাসায় গিয়ে ওই ম্যাডামের ক্লাসে যাবে না বলে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। পরে অভিভাবক অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে ক্লাসে পাঠান তাকে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ওই অভিভাবক বলেন, খুব শখ করে মেয়েকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপক চাপ ও কিছু কিছু শিক্ষিকার দুর্ব্যবহারের কারণে ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা। এ অভিভাবকের অভিযোগ, পরীক্ষার প্রশ্ন যে পদ্ধতিতে আসে সে পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষে পড়ানো হয় না। সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে প্রশ্ন করা হয়। এ অভিভাবকের মতো খ্যাতনামা এ স্কুলটির বিভিন্ন শাখার শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে অভিভাবকদের। অরিত্রীর আত্মহত্যার পর স্কুলটির শিক্ষিকাদের দুর্ব্যবহারের ব্যাপারে অভিভাবকদের অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা কেউই পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, স্কুলটিতে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকেই শিক্ষিকারা ছাত্রীদেরকে তাদের কাছে কোচিং করার জন্য প্রলুব্ধ করেন। তৃতীয় শ্রেণি থেকে তা তীব্র আকার ধারণ করে। জনশ্রুতি রয়েছে, তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে একাধিক শিক্ষিকার কাছে কোচিং না করলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া হয়। ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিংয়ে সাজেশন্স দেওয়া হয়। যারা কোচিং করে তারা ভালো ফল করে। ফলে অভিভাবকরা অনেকটা বাধ্য হয়েই সন্তানদের কোচিংয়ে দেন। তৃতীয় শ্রেণির এক শিশু শিক্ষার্থী জানায়, স্কুলের বোর্ডে শিক্ষিকার লেখা বুঝতে না পেরে কখনো প্রশ্ন করলে শিক্ষিকা তখন রেগে গিয়ে বলেন- ‘চোখে দেখিস না, আজই চোখের ডাক্তার দেখাবি। বেয়াদব কোথাকার।’ এ স্কুল থেকে পাস করে গেছে এমন এক শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, এ স্কুলে বড় মেয়েকে পড়াতে গিয়ে পড়াশোনা কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তাই সুযোগ থাকলেও ছোট মেয়েকে এই স্কুলে ভর্তি না করিয়ে সরকারি একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি।

 

ক্ষমা চাইলেন ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় ক্ষমা চেয়েছেন অধ্যক্ষ। মঙ্গলবার সকালে গণমাধ্যমকর্মীরা বেইলি রোডের স্কুল প্রাঙ্গণে তার কার্যালয়ে গেলে সবার সামনে হাত জোড় করে ক্ষমা চান তিনি। নাজনীন ফেরদৌস বলেন, বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। ঘটনাটি এতদূর গড়াবে তা অনুধাবন করতে পারিনি। আত্মহত্যার ঘটনায় আমি সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

মন্ত্রণালয়-স্কুলের তিন তদন্ত কমিটি 

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলা হয়, মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর) ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের পরিচালক অধ্যাপক মো. ইউসুফকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব। তদন্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন মাউশির ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের উপপরিচালক সাখাওয়াত হোসেন ও ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার বেনজীর আহমেদ। এদিকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক প্রিতিশ সরকারকে প্রধান করে এক সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের পৃথক কমিটি গঠন করেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষও। প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আশরাফ তালুকদার বলেন, প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষক জিন্নাত আরাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত জিন্নাত আরাকে স্কুলের সব ধরনের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

 

ক্ষুব্ধ ছাত্রীরা বলল, প্রিন্সিপালের পদত্যাগ চাই 

অসদুপায় অবলম্বন কিংবা নকল করার শাস্তি মৃত্যু কবে থেকে?সহ এরকম নানারকম প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড মঙ্গলবার সকাল থেকেই উত্তাল রাজধানীর বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল প্রাঙ্গণ। শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় স্কুলের অধ্যক্ষের পদত্যাগ ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবিতে স্কুলের ভেতর ও বাইরের সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তাদের হাতে রয়েছে নানা ধরনের প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড। এসব প্ল্যাকার্ডে লেখা রয়েছে ‘নো স্টুডেন্ট ডিজার্ভ টু বি ইনসালটেড (শিক্ষার্থীদের অপমান করা যাবে না)’, ‘প্রিন্সিপালের পদত্যাগ চাই’, ‘এডুকেশন এনলাইটেন আস, ইট ডাজ নট কিলস আস (শিক্ষা আলো দেয়, হত্যা করে না)’, ‘প্রত্যেকটি আত্মহত্যা কি একটা হত্যা নয়?’, ‘চিটিংয়ের পানিশমেন্ট মৃত্যু কবে থেকে?’, ‘উই ডিমান্ড অ্যানসার্স ফ্রম দ্য অথরিটি (প্রশাসন জবাব চাই)’, ‘এডুকেশন মেড অরিত্রী হ্যাং’ (অরিত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী শিক্ষাব্যবস্থা)’, ‘এটি আত্মহত্যা না এটি হত্যা’। অরিত্রীর সহপাঠী সুলতানা বিলকিস জানায়, ভিকারুননিসায় শিক্ষার্থীরা নিয়মিত নানা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। কারো কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমঝোতা করা উচিত। দশম শ্রেণির রাত্রী চৌধুরী বলে, একজন মেয়েকে অনেকের সঙ্গে সংগ্রাম করে পড়ালেখা করতে হয়। এরপরও স্কুলগুলো আমাদের নানাভাবে চাপে রাখে।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১