আপডেট : ২৭ November ২০১৮
আবহমানকাল থেকে কাঁসা-পিতলের কাজ ছিল শরীয়তপুর জেলার একটি ঐতিহ্য। অত্র এলাকার কাঁসা-পিতলের উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশের বহু জায়গায় বাজারজাত করা হতো। কালের প্রবাহে শরীয়তপুর জেলা থেকে তা প্রায় বিলপ্তি হতে যাচ্ছে। একসময় কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্রের ব্যবহার ছিল মানুষের ঘরে ঘরে। কাঁসা-পিতল ছাড়া মানুষের নিত্যদিনের কাজ চলত না। ঘরের থালা-বাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপহার হিসেবে ব্যবহার করা হতো কাঁসা-পিতলের হাঁড়ি, পাতিল, বালতি, কলস, বল, জগ, থালা, চামচ ইত্যাদি সামগ্রী। আর এসব তৈরি করা হতো, পালং বাজার, দাসাত্তা, বালাখানা, বিলাসখান, বালুচড়া, বাঘিয়া, কোটাপাড়া এলাকায়। সকাল থেকে শুরু করে কারিগররা গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতেন। হাজার হাজার শ্রমিক এ কাজে নিয়োজিত ছিল। এসব এলাকার উৎপাদিত সামগ্রী দেশের বিভিন্ন শহরে ও হাট-বাজারে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হতো। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পাইকার এসে অগ্রিম টাকা দিয়ে মাল কিনে নিত। আর মহাজনরা মাল তৈরি শেষে নৌকা বোঝাই করে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এসব পণ্য পৌঁছে দিয়ে উপার্জন করত বহু অর্থ। বিশেষ করে শরীয়তপুর জেলার তৈরি কাঁসা-পিতলসামগ্রী বিক্রি হতো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও হাট-বাজারে। আর কাঁসা-পিতলের কলসের চাহিদাও ছিল প্রচুর। ফলে এক মহাজনের আওতায় ৩০-৪০ কারিগর কাজ করতেন। সে সময় কাজের মজুরিও ভালো ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং স্বাধীনতা-উত্তর এলাকা থেকে ওইসব মহাজন ভারতে চলে যান। ফলে এ এলাকার কারিগররা হয়ে পড়েন বেকার। এ কারণে ধীরে ধীরে এ কাজ ছেড়ে দিয়ে অনেকেই রিকশা-ভ্যান, মোরগ-মুরগি, কাঁচামালের দোকান করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। বর্তমানে কাঁসা-পিতলের কাজ তেমন নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে কিছু কিছু মহাজন বাপ-দাদার পেশাকে ধরে রাখতে কিছু কিছু কারখানা চালু রেখেছে। এসব কারখানায় তেমন কারিগর নেই। অনেকের অভিযোগ, এ কাজ করে পোষায় না। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের তুলনায় কারিগরের মজুরি কম। কেননা এখন মহাজনের সংখ্যা কম। কাজের চাহিদাও কম। প্লাস্টিকের সামগ্রী বের হওয়ার পর কাঁসার চাহিদা বা কদর অনেকটা কমে গেছে। কেননা প্লাস্টিকের দাম কাঁসা-পিতলের চেয়ে অনেক কম। যারা বর্তমানে পূর্বের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তাদের মধ্যে ও অনেকে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছেন এ কাজ। কেননা সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা বা ব্যাংক থেকে প্রয়োজনী ঋণ সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। ফলে শরীয়তপুর জেলার একসময়ের গৌরব এবং ঐতিহ্য কাঁসা-পিতল বিলুপ্তি হতে চলছে। পালং বাজারের একজন কাঁসা-পিতলের ব্যবসায়ী রিয়াজ চৌকিদার বলেন, এখন আর আগের মতো কাঁসা-পিতলের ব্যবসা নেই, চাহিদাও নেই। আগেকার দিনে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী হিসেবে কাঁসা-পিতল ব্যবহার কর হতো। আর এখন কেনে শখের বসে। তা ছাড়া বর্তমানে কাঁচামালের ও সঙ্কট, চওড়া দাম দিয়ে এসব কাঁচামাল সংগ্রহ করে মাল তৈরি করতে হয়। ফলে দাম পড়ে যায় বেশি। এ কারণে অনেকেই কিনতে পারে না। এসব জিনিসের পরিবর্তে তারা স্টিল ও প্লাস্টিকসামগ্রী কিনে থাকে। তার পরও কিছু কিছু মানুষ শখের বসে এসব সামগ্রী কিনে থাকে। তাই আমরা এ ব্যবসা করে খুবই কষ্টে আছি। কোটাপাড়া গ্রামের দিলীপ কুমার বলেন, এ কাজ করে এখন আর পোষায় না। সারা দিন কাজ করে ২৫০-৩০০ টাকা রোজগার করে ছেলেমেয়ে নিয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকা খুবই কষ্টকর। কোনো কাজ থাকলে কাঁসা-পিতলের কাজ করতাম না। কাজ নেই বলে এ কাজ করি। দাসার্ত্তা গ্রামের দরিদ্র ইয়াছমিন বেগম বলেন, তিন কন্যাসন্তান নিয়ে সারা দিন কাজ করে যা পাই তা দিয়ে কোনো রকম খেয়েপরে বেঁচে আছি। কাজের তুলনায় মজুরি পাই না। তা ছাড়া আগের মতো এখন কাজও নেই। পালং গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২০ বছর যাবৎ এ কাজ করি। কিন্তু সংসারে অভাব আর কমছে না। খেয়েপরে থাকাই কষ্ট। তার পরও কোনো কাজ না থাকায় এ কাজ করি। তা ছাড়া ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে কোনো লোন দেয় না, আর আমাদের পুঁজিও নেই, যা দিয়ে বড় কোনো ব্যবসা করব। তাই পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। ভালো কোনো কাজ পেলে এ কাজ ছেড়ে দিতাম।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১