আপডেট : ১৭ November ২০১৮
বাঙালির ইতিহাসে অনুকরণীয় চরিত্রের রূপকার নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। তিনি কিছু নতুন মৌলিক চরিত্রের সঙ্গে বাঙালি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। হিমু এর মধ্যে একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র। যে চরিত্রটি তারুণ্যের উন্মাদনায় হয়ে উঠেছে চেতনাধর্মী। এছাড়া মিসির আলী, শুভ্র তো আছেই। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি আরেকটি ভিন্নমাত্রিক চরিত্র বাকের ভাই ও নান্দাইলের ইউনুস। তার টেলিভিশন নাটক— ‘কোথাও কেউ নেই’-এর চরিত্রে বাকের ভাইয়ের যেন শাস্তি না হয়, সেজন্য বাংলাদেশের শহর ও গ্রামগঞ্জে মিছিল হয়েছিল। ২. ভারতীয় বাঙালি লেখকদের বই পড়ার জন্য বাংলাদেশের পাঠককুলের হুমড়ি খেয়ে পড়ার দুর্নিবার আকর্ষণকে পিছুটান দিতে পেরেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সে জন্যই হয়তো হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সারা বিশ্বের বাঙালিদের মধ্যে একটা বিশাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও ভারতের বাংলা কাগজগুলোতে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। যদিও হুমায়ূন আহমেদ যে পাঠকসমাজ সৃষ্টি করেছেন তা চিরকালের জন্য বাংলার হয়েই থাকবে। হুমায়ূন আহমেদ পাঠকের এক বিশাল পৃথিবী গড়ে তুলেছেন যেখানে আছে আমাদের স্বকীয়তা, চেতনা, মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি। তাই হুমায়ূন আহমেদের অনুপস্থিতিতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে অনন্তকাল। হুমায়ূন আহমেদ আশির দশকে যে ধাক্কা দিয়েছিলেন, সে ধাক্কা বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে নাড়া দিয়েছে তাদের মূল ভিতে। তাকে ঘিরেই হয়তো হু হু করে বেড়েছে পাঠক। বই বিক্রি বেড়েছে। পশ্চিমের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের লেখক হয়েও যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে, তার উজ্জ্বল উদাহরণ কেবলই হুমায়ূন আহমেদ। ৩. একসময় বাংলাদেশে একমাত্র বিনোদনমাধ্যম বিটিভির সাদাকালো পর্দায় হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারগুলো বিনোদনে মেতেছিল। হুমায়ূন আহমেদের নাটক চলছে বিটিভিতে। তাই রাস্তা ফাঁকা। টিভি রুম যেন ফ্যামিলি হল। পুরো হাউজফুল। খোলা জানালায় পর্দার আড়ালে আলোর ঝলক। কখনো হাসি, কখনো নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝেই অট্টহাসির উল্লাস জানান দিত ফ্যামিলি হলে হুমায়ূন আহমেদের নাটক চলছে। বিটিভিতে তার প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’। এই নাটক জন্ম দেয় নতুন ইতিহাস। নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনি, ক্যানসারে যার মৃত্যু হচ্ছে; কিন্তু দর্শক সেটা মেনে নিতে পারছে না। ছোট্ট প্রিয় মেয়েটিকে মেরে না ফেলতে দর্শকরা কতভাবেই না অনুরোধ জানালেন নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদকে! ব্যানারে লেখা— টুনির কেন মৃত্যু হলো/ হুমায়ূন আহমেদ জবাব চাই। বিটিভির আরেক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ প্রচারের সময়েও ঘটেছে এমন কাণ্ড। নাটকের ‘বাকের ভাই’ চরিত্রের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতেও মিছিল। পত্রিকায় ছাপা হয় সে খবর। মধ্যবিত্ত বাঙালির ঈদ-উৎসব হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়া আনন্দের পরিপূর্ণতা পেত না। মধ্যবিত্ত বাঙালির ঈদ-উৎসবে হুমায়ূন আহমেদের ঈদের নাটক ছিল একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ঈদের সারা দিনের আনন্দ ও কর্মক্লান্তির পর সন্ধ্যায় টিভি সেটের সামনে আয়েশ করে বসে বাঙালি অপেক্ষা করত হুমায়ূন আহমেদের নাটকের জন্য। বাংলাদেশে টিভিনাটকের ইতিহাসে এরকম ঘটনা আর কোনো লেখক-নাট্যকারের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ৪. লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিভৃতে গড়ে তুললেন এক অনন্য প্রাকৃতিক নিদর্শন। ১৯৯৭ সালে মাটির কাছাকাছি থেকে সাহিত্যচর্চার প্রয়াসে গাজীপুরের পিরুজালিতে ভাওয়ালের শালবন পরিবেষ্টিত ৪০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন ছায়াঘেরা এক নিভৃত পল্লী। বড় ছেলে নুহাশের নামে পল্লীর নাম দেওয়া হয় ‘নুহাশ পল্লী’। এখানে রয়েছে দুর্লভ প্রজাতির অন্তত আড়াইশ বৃক্ষ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। গাছগুলো লাগিয়েছেন নিজের হাতে। গাছের গায়ে লিখে রেখেছেন গাছের নাম, গোত্র, জন্মস্থান এবং গুণাগুণের কথা। তিনি বহুভাবে জেনে বুঝে অনুসন্ধান চালিয়ে সাজিয়েছেন এই প্রকৃতিবিলাস। অবসর পেলেই তিনি ছুটে আসতেন নুহাশ পল্লীতে। এখানকার অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতেন। পরিবেশ ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন— এত গুণসমৃদ্ধ ওষুধি বৃক্ষ দেশের আর কোথাও একস্থানে নেই। নুহাশ পল্লী হতে পারে বৃক্ষ গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। ৫. নব্বই দশকের প্রথম দিক। হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন নতুন উপন্যাস ‘রুপালি দ্বীপ’। এই উপন্যাসের মাধ্যমে নতুন পরিচিতি পেল দেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা টেকনাফ উপজেলার সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ। তার ভাষায় নারিকেল জিঞ্জিরা। রুপালি দ্বীপ উপন্যাসের মাধ্যমে সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপ নিয়ে শুরু হলো মানুষের জানার কৌতূহল। ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ল দেশ থেকে বিদেশে। পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হলো। একটি উপন্যাস কীভাবে সমাজের মানুষের মনে প্রভাব সৃষ্টি করে, রুপালি দ্বীপ তার অনন্য উদাহরণ। ৬. হুমায়ূন আহমেদ তার সাহসিকতার কথা জানান দিয়েছেন কৌশলে এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের রচনায় হুমায়ূন আহমেদই প্রথম ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহারের সূচনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ-উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য রচনা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু সেখানে ধর্মীয় অনুষঙ্গ এবং ধর্মীয় চিত্রকল্পের ব্যবহার তেমনভাবে দেখা যায়নি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েরা সন্তানদের যুদ্ধ জয় করে নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসার জন্য নফল নামাজ পড়তেন। নফল রোজা মানত করতেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্যও নফল রোজা মানত করেছেন। এসব বিষয় আমাদের সাহিত্যে তেমনভাবে আসেনি। হুমায়ূন আহমেদ গুরুত্বের সঙ্গে অত্যন্ত সহজভাবে এসব বিষয় তুলে আনেন গল্প-নাটক ও সিনেমায়। তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ এবং ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’ উপন্যাস এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হুমায়ূন আহমেদ বুদ্ধিদীপ্ত সাহসিকতার সঙ্গে সামরিক স্বৈরশাসকের দম্ভের মধ্যেও ‘রাজাকার’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন তার নাটকে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তার ধারাবাহিক নাটক ‘বহুব্রীহি’র একটি চরিত্র পাখির মুখ দিয়ে উচ্চারণ করালেন ‘তুই রাজাকার’। হুমায়ূন আহমেদের এই অভিনব কৌশল দেখে যেমন সাধারণ মানুষ বিস্মিত হয়েছিলেন, তেমনি ‘রাজাকার’ শব্দটির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তাদের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ঘৃণারও বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। ৭. হুমায়ূন আহমেদের হাতে সৃষ্ট বিজ্ঞাপনচিত্র শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে দর্শক-হূদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। যেখানে চমৎকার রসবোধের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন বিষয়ের প্রয়োজনীয়তাকে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত শিক্ষা সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন আবদুল কুদ্দুস বয়াতির ‘এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে’; ডায়রিয়া সচেতনতামূলক সুজা খন্দকারের ‘দিলাম ঘুটা, ঘুটা’; জাটকা রক্ষাবিষয়ক সচেতনতামূলক ‘ইলিশ মাছের পোনারে টাকার খবর শোনারে’; চক্ষুদানে উদ্বুদ্ধকরণবিষয়ক ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’র মতো বিজ্ঞাপনগুলো বাংলাদেশের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ৮. আবিষ্কারের অনুঘটক হুমায়ূন আহমেদ। নানান বিষয়, স্থান, কাল, পাত্র ও চরিত্রকে তিনি আবিষ্কারের অন্তর্জালে ছেঁকে তুলেছেন। বাঙালির ঐতিহ্য লোকসঙ্গীত প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল। যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শহুরেরা নাগরিক অহমিকায় বাংলার মাটি ও মানুষের গানকে ‘গেঁয়ো সংস্কৃতি’ বলে নাক সিটকাতো, হুমায়ূন আহমেদ তার জাদুকরি মহিমায় সেই মাটি ও মানুষের লোকসঙ্গীত, লোকসংস্কৃতিকে নাগরিক মধ্যবিত্তের সুসজ্জিত ড্রইংরুমে সমাদৃত করিয়েছেন। এখন শহুরে তরুণ মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা ছেড়ে বাংলার অন্যান্য লোকসঙ্গীতের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ রচিত ‘ও আমার ওড়াল পঙ্খি রে’, ‘ও কারিগর দয়ার সাগর’ গান শুনছে এবং গাইছে। তার আবিষ্কার শুধু তাকেই জনপ্রিয় করে থেমে থাকেনি। কখনো কখনো তার বিষয় ও চরিত্রকেও জনপ্রিয় করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেও করেছে জনপ্রিয়তায় সহচর। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে তিনি নেত্রকোনা অঞ্চলের মালজোড়া বাউল গানের বিশিষ্ট গায়ক ও গীতিকারদের নতুনভাবে আবিষ্কার করেন। মরমি সাধক রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সী, জালাল উদ্দিন খাঁ, সিলেট অঞ্চলের হাসন রাজাসহ অনেকের সৃষ্টির সঙ্গে তার ছিল প্রত্যক্ষ নিবিড় সংযোগ। বাউল গানের আসর, হালকা জিকিরের গান, মারফতি, দেহতত্ত্ব, লোককাহিনী, লোকছড়া, লোকসাহিত্য, লোকপ্রবাদ, লোকপ্রবচন— এসব বিষয়ে হুমায়ূনের ছিল প্রবল আগ্রহ। কেন্দুয়ার কুদ্দুস বয়াতি, বাউল গায়ক ইসলাম উদ্দিন হুমায়ূন আহমেদের অনন্য আবিষ্কার। আর বিটিভির অডিশনে আউট হওয়া আফজাল শরীফ নাট্যকারের বিশেষ অনুরোধে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে নিজের প্রথম অভিনয়েই সবার মন জয় করে আজ স্ব-নামে প্রতিষ্ঠিত কৌতুক অভিনেতা। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাই হুমায়ূন হয়ে ওঠেন এক অনন্য হুমায়ূন আহমেদ। ৎ
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১