বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৭ November ২০১৮

কাম খুলেছে প্রেমের দরজা...


আদোনিস, অসাধারণ এক কবি। ২০১৭ সালে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম তাকে। ঢাকায় এসেছিলেন একটা সাহিত্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে। খুব ছোটখাটো মানুষটি, কিন্তু কী বিনয়ী আর মধুর তার ব্যবহার। সেলফি তোলার জন্য সবাই যখন তাকে ঘিরে ধরছিল, নিঃশব্দে হাসিমুখে সবার আবদার মিটিয়ে চলেছিলেন তিনি। একসময় আমিও সুযোগ পাই তার সঙ্গে ছবি তোলার। সত্যি, সেটা ছিল আমার জীবনের একটা স্মরণীয় মুহূর্ত। স্মরণীয় বলব এ কারণে যে, এই মুহূর্তে যদি বিশ্বশ্রেষ্ঠ জীবিত দুজন কবির কথা কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি তাহলে নিঃসন্দেহে আদোনিসের নামটাই সবার আগে উচ্চারণ করব।

বছর দশেক আগে আমি যখন বিদেশি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়াতাম, তখন তার একটা কবিতার বই আমার হাতে আসে। বইটিতে সংকলিত হয়েছে আদোনিসের সব প্রেমের কবিতা। বইটির নাম তিনি রেখেছেন ‘কেবল সমুদ্রই হয়তো ঘুমাতে পারে : প্রেমের কবিতা’। আমি তখনই বেশ কয়েক দিন মোহাচ্ছন্নের মতো ফ্রান্সের প্যারিতে বসবাসরত সিরিয়ার এই বিশ্বখ্যাত কবির ওই বইয়ের প্রেমের কবিতাগুলো পড়ে ফেলি। বলতে দ্বিধা নেই, প্রেমের কবিতা কবিতাচর্চার আদিকাল থেকে অনেকেই লিখেছেন। এখনো লিখছেন। প্রেম কবিদের কবিতার একটা প্রিয় বিষয়। কিন্তু এই সময়ে আদোনিসের মতো এত ভালো প্রেমের কবিতা কেউ লিখেছেন কি-না মনে করতে পারছি না। আসলে আদোনিসের ওই বইয়ের প্রতিটি কবিতা আমাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে দিয়েছে। সেই তাড়নাতেই আমি ওই বইয়ের কবিতাগুলো অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। পরে একটি-দুটি করে তার প্রেমের কবিতাগুলো অনুবাদ করতে থাকি। এখনো আমি সেটা করছি। বাংলাদেশে, বলা বাহুল্য এর আগে তার দু-একটি অনূদিত কবিতার বই আমার চোখে পড়েছে। কিন্তু কোনো সংকলনেই দুটি-একটি ছাড়া তার সমগ্র প্রেমের কবিতা আমার চোখে পড়েনি।

আদোনিস এই মুহূর্তে আরবি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। জন্ম উত্তর সিরিয়ার আলওয়াইত এলাকায়। সিরিয়ায় পড়াশোনা শেষে বৈরুতের সেন্ট জোসেফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বোঝাই যায় কতটা উচ্চশিক্ষিত তিনি। আমাদের এখানে কবিদের মধ্যে এক ধরনের, কী বলব, উন্নাসিকতা বা ঈর্ষা আছে, পিএইচডির মতো উচ্চশিক্ষা থাকলে নাকি তিনি কবি হতে পারেন না। অথচ বিশ্বে অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে, যারা এরকম উচ্চশিক্ষিত আবার অসাধারণ কবিও। এলিয়ট থেকে আদোনিস, এরকম অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে। আসলে আমাদের মধ্যে তো দুই প্রজন্মের আগে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ ছিল না, সেজন্যই অনেকে এরকম হীনম্মন্যতায় ভোগেন। এখানে অবশ্যই বলা প্রয়োজন, আবার এরকম উচ্চশিক্ষিত হলেই যে ভালো কবিতা লিখবেন এমনটাও নয়। আসলে যার অনুভবে-আবেগে কবিতার বীজ রয়ে গেছে, তিনি উচ্চশিক্ষিত হতেও পারেন আবার নাও পারেন। কিন্তু ঢালাওভাবে কারো কবিতা না পড়ে তার শিক্ষার বিষয়টি যদি শুধু বিবেচনা করা হয়, তাহলে সেটা, আমি বলব, একধরনের মূর্খতা বা ঈর্ষাজনিত উচ্চারণ। 

আদোনিসের জীবনে, অন্য অনেক নির্বাসিত কবির মতো অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। রাজনৈতিক কারণে জেল খাটার পর লেবাননের নাগরিক বনে যান (১৯৬১) তিনি। এরপর চলে আসেন প্যারিতে। সমালোচকদের মতে, আরববিশ্বে তার কবিতা অবিস্মরণীয় প্রভাব বিস্তার করেছে। এ কারণেই তার বিশ্বখ্যাতি। সমালোচকদের অভিমত, আরবি কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে সনাতন ধারার আরবি কবিতার প্রকরণ আর ভাষাকে তিনি আমূল বদলে দিয়েছেন। আরবি কবিতাকে বিশ্বকবিতার ধারায় যুক্ত করেছেন। প্রায় প্রতি বছরই তিনি নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন, পাঠক-সমালোচকদের পছন্দের তালিকাতেও তিনি থাকছেন। একমাত্র হোর্হে লুইস বোর্হেস ছাড়া অন্য কোনো কবি এভাবে নোবেল পাওয়ার দোরগোড়ায় বার বার উঠে আসেননি। কিন্তু ঠিক বোর্হেসের মতো নোবেল পুরস্কার কমিটি এখনো তাকে পুরস্কৃত করেনি। কিন্তু কেন যে তিনি নোবেল পাচ্ছেন না (বোর্হেসও পাননি), সে আরেক বিস্ময়!

আদোনিস কিন্তু তার প্রকৃত নাম নয়। তার পরিবার-প্রদত্ত নাম আলী আহমদ সাইয়ীদ। নগীব মাহফুজের পর, এমনকি নগীবকে ছাড়িয়েও তিনি খ্যাতিমান- আরববিশ্বে এবং সারা পৃথিবীতে। যদি আগামী বছরই তিনি নোবেল পেয়ে যান, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

প্রেম, বলা বাহুল্য, এক অবিস্মরণীয় মানবিক অনুভূতি। প্রেমের কবিতার বৈশিষ্ট্যও আলাদা। পৃথিবীর বোধহয় সবচেয়ে মধুর বাক্য হচ্ছে এটি : ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। কিন্তু প্রেমের কবিতা লেখা সহজ নয়। প্রেমের কবিতার নন্দনতত্ত্ব, নেরুদা একবার বলেছিলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতীকী। কবিকে বস্তুপৃথিবীর সঙ্গে নিজের অনুভূতিকে মিশিয়ে কবিতা রচনা করতে হয়। কিন্তু সরাসরি নয়, আশ্রয় নিতে হয় রূপক, প্রতীক, উপমা ও চমকপ্রদ বাকপ্রতিমার। পাঠকও কবির ভাবনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান, কবি কী বলতে চাইছেন, কীভাবে বলছেন, সেসব বোঝার জন্যে।

লক্ষণীয়, আদোনিসের প্রথম দিকের প্রেমের কবিতা স্থান ও কালগত দিক থেকে অনেকটা সুনির্দিষ্ট। একজন কথক ঘুরে-ফিরে কথা বলে। এখানে প্রেম এই শব্দটিই ব্যবহূত হয়েছে সরাসরি। তৃতীয় কবিতায় উত্তম পুরুষটি সরে গিয়ে সেখানে আবির্ভাব ঘটছে প্রেমের দুই পাত্রপাত্রী- আমি আর তুমির। এখানেই প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে উপস্থিত। কবিতাগুলোতে ব্যবহূত হয়েছে চমকপ্রদ অসংখ্য প্রাসঙ্গিক বাকপ্রতিমা। অনুভূতিও হয়ে ওঠে আরো ঘন আরো তীব্র। কবিতার এই নান্দনিক ও সাংগঠনিক কাঠামোকে ঘিরেই রচিত হয় আদোনিসের কবিতা। ওই বইয়ে অন্যান্য প্রেমের কবিতার সঙ্গে ‘এইভাবে শুরু’ শীর্ষক তেরোটি কবিতায় আগে অনুসৃত কাব্যরীতিকে প্রায় বর্জন করে প্রেমের কবিতার সীমাকে তিনি অনেক প্রসারিত করে দিয়েছেন। কয়েস (মজনু) ও লায়লা- সপ্তম শতাব্দীর ইতিহাস থেকে তুলে এনেছেন এই যুগলকে যাদের প্রেম বিশ্বব্যাপী পরিচিত। সময়ের ক্রমকে ভেঙে তিনি রচনা করলেন অনুভূত আবেগের ওপর নির্ভরশীল কামনা-বাসনাময় কবিতা। শরীর প্রাধান্য পেল এসব কবিতায়, যৌনতার সংস্পর্শে কবিতাগুলো জ্বলে উঠল নতুন বাকভঙ্গিমায়। একটি দীর্ঘ কবিতায় আবার ইঙ্গিতগর্ভ অনুষঙ্গ নিয়ে আবির্ভূত হলো কয়েস বা মজনু। এখানে প্রেমিকার শরীর হয়ে উঠল আরো সংরক্ত, স্পর্শময়, যৌন অনুভবে সক্রিয়। এই শরীর দেখতে পাচ্ছি হয়ে উঠল উর্বর শস্যক্ষেতের প্রতীক, যেখানে কাঁটা আর শস্যের সমাহার। নারীর কত যে রূপ : অগ্নি, নদী, পুষ্প, নগর ইত্যাদি। আদোনিসের দীর্ঘ প্রেমের কবিতাগুলো, সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বেশ গভীর আর বৈচিত্র্যময়। আত্মগত অনুভূতি আর শরীরী সংরাগে অপূর্ব, অনন্য। এখানে আমি আমার অনুবাদে তার কবিতা উপস্থিত করছি। লক্ষ করে দেখুন, ঐতিহ্য, শরীর, কাম কতটা অনন্য মহিমায় অবিমিশ্র হয়ে আদোনিসের কবিতায় মিশে আছে।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১