বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৭ October ২০১৮

কথাসাহিত্যিক

গ্রহণ বর্জনের সংস্কৃতি


‘বাংলাদেশের খবর’— বাংলাদেশে আরো একটি নতুন দৈনিক কাগজের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। দেশে এখন দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা কম তা বলা যাবে না। এত পত্রিকার প্রয়োজন আছে কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। আর ঠিক এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্র মানে কী? রাষ্ট্র সার্বভৌম। এর সার্বভৌমত্বে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যারা ক্ষমতায় আসেন তারা কিন্তু রাষ্ট্র এবং সার্বভৌম— এ দুটিকে গুলিয়ে ফেলেন। ক্ষমতায় এলেই শাসক ধরে নেন রাষ্ট্রটা তাদেরই। দেশের শাসনব্যবস্থায় তিনটি ভাগ আছে : বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ। আমাদের একটা জাতীয় সংসদ আছে। জাতীয় সংসদের নির্দিষ্ট কাঠামো আছে। নতুন আইন এখান থেকেই করা হয়। তখন সেটা জনগণের সৃষ্ট আইন। জনগণের প্রতিনিধিরাই ওই সংসদে বসেন। অতএব তারাই দেশ শাসন করছেন।

১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিরাট একটা গৌরবের অধিকারী হয়েছে। পৃথিবীর খুব কম দেশই এমন গৌরব অর্জন করতে পেরেছে। দেশটির বয়স এখন ৪৭ বছর অর্থাৎ অর্ধশতাব্দীর কাছাকাছি হতে চললো। এই অর্ধশতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেশের মানুষ দৈনিকগুলোর ওপর কতটা আস্থা রাখতে পারছে, সেটিও ভাববার বিষয়। এখানে অবশ্য প্রচুর পক্ষপাত থাকে। তবে যে কোনো পত্রিকাই কোন গুরুত্বপূর্ণ দিকটা তুলে ধরতে চায়, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। তবে বর্তমান সময়ে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ওপর যে সামাজিক ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে চলছে, সেগুলো পত্রিকার পাতায় সোজাসাপ্টা আসা উচিত।

এই কথাটা আজ স্পষ্ট করে বোঝা ও বলা দরকার যে, সরকারি সংস্কৃতি দেশের শোষণ ও শাসনকারী প্রধানশ্রেণির প্রয়োজনে তৈরি সংস্কৃতি। শোষণ ও শাসনের প্রয়োজনেই সরকারকে রাজনীতির ছক বের করতে হয়, একটা করে শিক্ষানীতি, শিল্পনীতি, কৃষিনীতি থলে থেকে হাজির করতে হয়। একটা সংস্কৃতি নীতিও খাড়া করতে হয়। এই কথাটা মনে রাখলেই, সরকারি সংস্কৃতি-নীতিটিকে সরাসরি বর্জন না করে উপায় থাকে না আমাদের পক্ষে। এর সঙ্গে খোদ সংস্কৃতিরই কোনো যোগসূত্র নেই এই কথাটার ঠিকমতো প্রত্যয় জন্মালে একমাত্র তখনই অতি ধর্মপ্রাণ মুসলমানও আর সরকারের ধর্ম ধর্ম চিৎকার শুনে বা ইসলামের ঝাণ্ডা উড়ানো দেখে বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হবে না। ব্যাপারটার কদর্য  রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট দেখতে পাবেন। পাকিস্তানি আমলের তেইশটা বছর ধরে ইসলামের এই ঝাণ্ডা উড়ানো আমরা দেখেছি, ভাড়াটে মোল্লা মওলানাও কম জোটেনি এই কাজে; কিন্তু একাত্তর সালে এসে বাংলাদেশের মানুষের হাতে যখন পাকিস্তানের শোষণের দুর্গ ভিতসুদ্ধ কেঁপে উঠলো, তখন ইসলামের ঝাণ্ডা নামিয়ে ফেলতে এতটুকু দ্বিধা করলো না পাকিস্তানি শাসকরা। এই অতি তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বাংলাদেশের মানুষ প্রাণে প্রাণে বুঝে গেল, ধর্ম বা ইসলাম নয়, শিল্প বা সংস্কৃতি নয়, সব সময় দেশের ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণি সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারেন ক্ষমতার ব্যাপারটি আর তার সঙ্গে খাপ খাইয়েই তাদের নানা পরিকল্পনা রচনা করতে হয়। সংস্কৃতিনীতি এই রকম একটি পরিকল্পনা মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।

প্রসঙ্গটিকে এইবার একটু অন্য পাশ থেকে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সীমানা কি সংস্কৃতির সীমানার সঙ্গে সব সময়েই দাগে দাগে মেলে? আমাদের পরিচিত আজকের পৃথিবীর গত একশ বছরের ইতিহাস চোখের সামনে রাখলে মুহূর্তে বোঝা যায়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় একটা হিসাবে খুবই ক্ষণস্থায়ী; রাষ্ট্রীয় সীমানা ও রাজনৈতিক চৌহদ্দি বার বার মুছে যাচ্ছে; রাষ্ট্র জন্মাচ্ছে, রাষ্ট্র মরছে, মিশে যাচ্ছে, নতুন রাজনৈতিক পরিচয় দেখা দিচ্ছে, লোপ পাচ্ছে। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, একটি মানুষের জীবনসীমার মধ্যেই এই উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পরিচয় যেভাবে বদলেছে, তাতে বলতে হয় রাষ্ট্রের আয়ু সব সময়েই দীর্ঘ নয়। অন্যদিকে জাতি আর সংস্কৃতি সম্বন্ধে কি সে কথা বলা চলে? একই ভূখণ্ডের রাষ্ট্র-নাম বার বার বদলাচ্ছে। বলতে গেলে পৃথিবীর ইতিহাসই তা-ই। প্রাচীন পৃথিবীর রাষ্ট্রবিন্যাসের চিহ্নমাত্র আজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই ভেবে দেখতে হয়, সংস্কৃতির সীমানা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক সীমানার আনুগত্য করছে, না, বার বার সে সীমানা অতিক্রম করে যাচ্ছে? অন্যভাবে বলা চলে, পৃথিবীর মানচিত্র এটাই প্রমাণ করে যে, একই সংস্কৃতির বিশাল সীমানার মধ্যে নানা প্রয়োজনে মানুষ রাষ্ট্রীয় গণ্ডি টানে। প্রাচীন গ্রিসে হেলেনীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত ছিল কতগুলো রাষ্ট্র? তাদের তো সীমা সংখ্যা নেই। অথচ রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের কি বিভিন্নতাই না সেখানে ছিল? কিন্তু তাদের সকলের জায়গা হয়েছিল গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে। হেলেনীয় সংস্কৃতির প্রসারভুক্ত ভূখণ্ডের আজকের রাজনৈতিক পরিচয় কী? তার সীমানা কি শুধুই বর্তমান গ্রিস? কাজেই দেখতে পাচ্ছি এক সংস্কৃতির এলাকা ও অধিবাসীদের নানারকম ভাগ করে নানা রাষ্ট্রের উদ্ভব যেমন ঘটতে পারে, একরাষ্ট্র একাধিক সংস্কৃতিকেও তেমনি জায়গা দিতে পারে। 

মাত্র সাড়ে তিন দশকের ইতিহাস ধরেই বিচার করা যাক। ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত যে ভূখণ্ড পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল, অবিকল সেই ভূখণ্ডই আজ বাংলাদেশ নামে পরিচিত। এই ভূখণ্ডে যারা বসবাস করছে তাদের জাতি পরিচয়, ভাষা পরিচয়, ধর্ম পরিচয় কোনো কিছুই বদলায়নি, বদলেছে শুধু রাষ্ট্র পরিচয়। এখন রাষ্ট্রশাসকগণ চাইলেই কি এই জাতি পরিচয়, ভাষা সংস্কৃতি ধর্ম পরিচয় বদলে ফেলা যাবে? সেটা কখনোই সম্ভব নয়। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র ঠিক সেটাই চেয়েছিল। তার আবদার ছিল ভাষা পরিচয় ভুলতে হবে, জাতি পরিচয় ত্যাগ করতে হবে, সংস্কৃতি পরিচয় বর্জন করতে হবে, ইতিহাস ভুলতে হবে, সব ঐশ্বর্য ছেড়ে দিয়ে ভিখিরি হয়ে শুধুমাত্র একটা ধর্ম পরিচয় গড়ে তুলতে হবে, একটা সম্প্রদায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। এই অস্বাভাবিক অভিপ্রায় পূরণ করতে দেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা আজ সুচিহ্নিত। জানি, রাষ্ট্রসত্তা অতি প্রবল আকর্ষণে ব্যক্তিকে টানে। যে রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ— সেই রাষ্ট্রের সব দাবি তার অধিবাসীদের মেটাতে হবে, জন্ম জীবন মৃত্যু তার মধ্যে, তার জন্যে প্রাণ দিতে হবে। কিন্তু তাকে কোথাও অতিক্রম না করেও বাংলাদেশের মানুষ বিশাল বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার দাবি করবে, তাকে আত্মস্থ করবে, তার বর্তমানকে জীবন্ত, পরস্ফুিট, চলন্ত করতে চাইবে তার অতীত দিয়ে এ তো খুবই স্বাভাবিক। কে কবে চিন্তা করতে পারে যে, একদা পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মানুষরা কান্ট হেগেলের দাবি নিয়ে মারামারি করছে? শুধু এই বাংলাদেশে, এই শোষণের পীড়নের জালে জড়িয়ে পড়া বাংলাদেশেই আজ যুক্তি দেখাতে হয় কেন পান করবো বিশুদ্ধ তৃষ্ণার বারি, কেন নিঃশ্বাস নেব মুক্ত বায়ুতে, কেন থাকতে চাইবো সুস্থ সবল। শোষণের পীড়নের জাল ছিঁড়তে হলে এই উদ্ভূত পরিস্থিতিটা নিয়েই ভাবতে হবে।

আর এই ভাবনার কাজটি সাধারণ মানুষের মধ্যে তড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে দিতে পারে একমাত্র পত্রিকা। যদিও পত্রিকা বের করা এখন একটা ব্যবসারও অঙ্গ। বড় বড় দেশেও জানি একটি বা দুইটি পত্রিকাই মোটামুটিভাবে কেন্দ্রে অবস্থান করে। এখন আমাদের প্রচুর মিডিয়া। সেজন্য নতুন কিছু করা প্রায় অসম্ভব। নতুনত্ব যদি কোনোভাবে চালু হয়, তাহলে পত্রিকা চালু হবে। দৈনিক পত্রিকার প্রতিযোগিতার ভিড়ে সেটি হারিয়ে যাবে না। আর তাই বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে ওই সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখতে মূলমন্ত্র হয়ে কাজ করতে হবে আজকের কাগজগুলোকে।

 

 

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১