বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৬ October ২০১৮

নন্দিতার ‘মান্টো’


গল্পটির নাম ‘ঠান্ডা গোশত’। গল্পকার সাদাত হাসান মান্টো। গল্পটিতে দেখা যায়, সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়কার দাঙ্গায় এক মুসলমানের রক্তে হাত রাঙানো শিখ যুবক ঈশ্বর সিংহ ঘরে ফিরে কিছুতেই প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারছে না। প্রেমিকার সন্দেহ, তার মরদ নিশ্চয়ই অন্য নারীসঙ্গে মজেছে। ঈর্ষার জ্বালায় ঈশ্বরের কৃপাণ কোষমুক্ত করে সে ক্ষতবিক্ষত করে তাকে। মুমূর্ষু ঈশ্বর স্বীকার করে, সে এক অচেতন মুসলিম বালিকাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ক্রমেই বুঝতে পারে আসলে সে বালিকাটির লাশের সঙ্গে...। তীব্র সংবেদনশীল এই গল্প। ‘আমরা মুসলমানরা এতই আত্মমর্যাদারহিত যে, আমাদের মৃত কন্যাদেরও শিখরা ধর্ষণ করে যায়?’ এমন প্রশ্ন তুলে লাহোর আদালতে মামলা ঠুকে দেয় পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র। গল্পটির মর্মান্তিক মানবিক দিকটি বুঝতেই পারেনি পাকিস্তান সরকার। কিন্তু এরকম গল্প যিনি লিখেছিলেন, তিনিই সাদাত হাসান মান্টো। 

‘সাদাত হাসানের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু মান্টো বেঁচে থাকবেন।’ কথাগুলো বলেছেন নন্দিতা দাস, তার পরিচালিত সদ্য মুক্তি পাওয়া মুভি ‘মান্টো’ সম্পর্কে। ২০১২ থেকে মুভিটা নিয়ে কাজ করছিলেন নন্দিতা। সেই বছরটা ছিল মান্টোর জন্মশতবর্ষ। গবেষণা করতে করতে নন্দিতার মনে হলো, এই লেখককে নিয়ে দারুণ একটা মুভি বানানো যায়। নন্দিতা দেখলেন, অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন মান্টোকে নিয়ে। কিন্তু এমন কিছু কথা আছে, যার হদিস তিনি পেলেন লাহোরে গিয়ে মান্টোর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে। আর এ জন্যই ছয় বছর লেগে গেল মুভিটা বানাতে। শুরু থেকে নন্দিতা এভাবেই লেগে ছিলেন মুভিটার পেছনে। দিনের পর দিন শুধু কাজ করে গেছেন। মুভির কারণেই একদিন লাহোরে গিয়ে মান্টোর শ্যালিকার সঙ্গে দেখা করেছেন। কথা বলেছেন মান্টোর জীবিত সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। মুভির চিত্রনাট্য দেখিয়েছেন মান্টোর ছোট মেয়েকে। মান্টো সম্পর্কে তিনি এমন কিছু কথা বলেছিলেন নন্দিতাকে, যা কারো লেখায় পাননি নন্দিতা। মুভির ঘটনাকালটাও ভারতভাগের সবচেয়ে তুঙ্গতম মুহূর্ত : ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল। স্বাভাবিকভাবেই এতে এসেছে গান্ধীহত্যার কথা, জিন্নাহর কথা। মুম্বাই মুভিজগতের তখন উজ্জ্বল নাম মান্টো। ১৯৩৬ সালে এই শহরে এসেছিলেন তিনি। এখানেই ছিল তার উড়নচণ্ডী বোহেমিয়ান জীবনযাপন। সিনেমার জগতে উজ্জ্বল পদচারণা। চিত্রনাট্য লিখছেন। গল্প লিখছেন। নিবন্ধ লিখছেন। ইসমাত চুগতাইয়ের সঙ্গে তুমুল সখ্য তার। ঘুরে বেড়াচ্ছেন আলো ঝলমল ইনটেলেকচুয়াল আড্ডাখানা থেকে যৌনপল্লির কানাগলিতে। একদিন শুনলেন, জিন্নাহ বলেছেন ভারতে থাকলে মুসলমানরা কাটা পড়বে। বিমূঢ় হয়ে পড়লেন মান্টো। যে দেশে তার বাবা-মায়ের কবর, সেই দেশ তার নয়! চেনা মানুষ আর বন্ধুর মুখে মুসলমান বিদ্বেষের কথা শুনে শিউরে উঠলেন। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত আর সেক্যুলার নেই। মুসলমানরা তখন কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেন। কাজ না পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন চারদিকে। মান্টো মুম্বাই ছাড়লেন। থেমে যায় তার কলম। নিজের হাভেলির মতো শহর ছেড়ে পাড়ি জমালেন লাহোরে। দেশভাগের মতো খণ্ডিত হয়ে পড়লেন মান্টো। মুম্বাইতে রয়ে গেল তার সব রচনা, তিনশ’র মতো ছোটগল্প আর অন্যসব লেখা। ‘ঠান্ডা গোশত’ নামে লিখলেন যে গল্পটি, সেটি অশ্লীলতার দায়ে লাহোর আদালতে উঠলে ক্রুদ্ধ মান্টো বলে উঠলেন, সাহিত্য নগ্ন হবে না? যেখানে মানুষ রাস্তায় নারীকে ফেলে তাকে শিকার করছে? তার কোলের বাচ্চাকে হত্যা করছে? সাহিত্য সেটা প্রকাশ করবে না? চুপ থাকবে?

পাকিস্তানে গিয়েও মান্টো দেখলেন ধর্মান্ধতা আর ‘দ্বিজাতি তত্ত্বে’র নখরে ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেশটি। মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত। পাকিস্তানে গিয়ে যে মান্টো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি, সেটা বোঝা যায় তার সে সময়ের জীবনযাপনটি লক্ষ করলে আর গল্প-নিবন্ধগুলো পড়লে। মুম্বাইয়ের জীবনটাকেও তিনি পেছনে ফেলে আসার চেষ্টা করেছিলেন। আর তাই গভীর সখ্য ছিল যে গল্পকার ইসমাত চুগতাইয়ের সঙ্গে, তার পাঠানো চিঠিও একসময় খুলে পড়েননি।

গল্প রচনায়ও হয়ে উঠেছিলেন সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষুরধার নির্মম বিশ্লেষক। ‘ফিরে আসা’ মান্টোর এরকমই একটা গল্প। স্ত্রী হারানো পিতা সিরাজুদ্দিন পরমাসুন্দরী কন্যা সাকিনাকে উদ্ধার করার জন্য মুসলমান কিছু স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্য নেয়। একদিন স্ট্রেচারে করে সাকিনার হাসপাতালে ঢোকার মুহূর্তে সেও পিছু পিছু ঢোকে। ডাক্তার তাকে ঘরের বন্ধ জানালা দেখিয়ে বলে ‘খুলে দাও’। এই কথাটা বলেই হিন্দু-মুসলমানরা সাকিনাকে যেভাবে নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে, স্বাভাবিকভাবেই সাকিনার হাত সালোয়ারের দড়ি খুলতে উদ্যত হয়। দু-পা ফাঁক করে সে প্রস্তুতি নেয়। আরেকটি গল্পে হিন্দু বালিকা শারদার প্রেমে পড়া মুসলমান কিশোর মুখতার ‘ধর্ম তুচ্ছ’ বলে মনে করলেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য প্রেমিকাকে চাপ দিয়ে বিয়ে করতে চায়। প্রেমিকা শারদা পাল্টা তাকে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করার কথা বললে মুখতার ইসলামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বক্তৃতা ঝাড়ে আর শারদাদের বাড়ির বন্ধ দরজা থেকে ‘বুকে ইসলাম’ নিয়ে ফিরে আসে। এরকম তীক্ষ চাবুক-কষা গল্প পাকিস্তানিরাই বা কীভাবে সহ্য করবে? লাহোরে বসে মান্টো বিদ্রূপ করে লিখলেন, একদিন পাকিস্তান সরকার হয়তো তার কফিনটি কোনো না কোনো উপাধিতে ভূষিত করবে। ২০১২ সালে ঘটেছেও তা-ই। তাকে ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাবে ভূষিত করে পাকিস্তান সরকার। মান্টো তার এপিটাফে লিখে রেখে গেছেন, ‘এই কবরে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই গল্পকার, যে ভাবছে কে বেশি ভালো গল্পকার-সে নিজে নাকি খোদা!’ কিন্তু কী নিষ্ঠুর পরিহাস, ধর্মান্ধদের ভয়ে তার কবরে এই একটি বাক্যও খচিত করে দেওয়া সম্ভব হয়নি তার পরিবারের! সাতচল্লিশের দেশভাগের সবচেয়ে নির্মম শিকার হচ্ছেন এই লেখক— সাদাত হাসান মান্টো। দেশভাগ ও দাঙ্গার সবচেয়ে সফল কথাকারও তিনি।

মান্টোর জন্ম (১১ মে ১৯১২) জালিয়ানওয়ালাবাগের অমৃতসরে। ১৯৩০-এর দশকে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের দলে ভিড়ে যান। কিন্তু ছকবাঁধা রাজনৈতিক মতাদর্শে আবদ্ধ থাকেননি। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানবিক সম্পর্কের ক্ষতবিক্ষত চেহারাটি তিনি তুলে ধরেছেন। সমাজের নিচুতলার সব শ্রেণির মানুষের জীবন তাকে সাহিত্যচর্চায় প্রাণিত করেছে সবচেয়ে বেশি। ‘গন্ধ’ শীর্ষক একটি গল্পে দেখা যায়, বিত্তবান তরুণ বৃষ্টিতে ভেজা এক কাজের বুয়ার সঙ্গে সম্ভোগে লিপ্ত হচ্ছে। ওই নারীর ঘামেভেজা শরীরের গন্ধ তাকে মাতাল করে তুলছে। পরে বাসর রাতে ধনীকন্যার সাহচর্যে সেই গন্ধের অনুপস্থিতিতে যুবকটির আসঙ্গলিপ্সা পুরোপুরি উবে যায়।  

এবার নন্দিতার চলচ্চিত্রের কথায় ফিরি। মান্টোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী আর তার স্ত্রী সোফিয়ার চরিত্রে রাশিকা দুগাল। রাশিকা দুগালের ক্যারিয়ারের এটা হচ্ছে সবচেয়ে স্মরণীয় অভিনয়। ঋষি কাপুর ও জাভেদ আখতারও আছেন এই ছবিতে। নওয়াজ, নন্দিতা জানিয়েছেন, ‘সামান্য পারিশ্রমিক’ নিয়েছেন। ঋষি ও জাভেদ নেনইনি। ‘মান্টো’ চলচ্চিত্রের ন্যারেটিভটাও গতিময়, টানটান আর তীব্র সংবেদনশীল। সেকালের মুম্বাই শহর আর চলচ্চিত্রের চমৎকার আবহ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এর আখ্যানাংশ। সে সময়ের হিন্দি চলচ্চিত্রের গানের ব্যবহার আছে ছবিটিতে। মান্টোর সাহিত্যকৃতির কথাও সংযোজিত হয়েছে। শুরু হয়েছে তার ‘দশ রুপিয়া’ গল্পটি দিয়ে আর শেষ হয়েছে ‘টোবাটেক সিং’ দিয়ে। ‘মান্টো’ ছবির চিত্রনাট্যকার পরিচালক নন্দিতা দাস নিজেই। ছবিতে আরো যাঁরা অভিনয় করেছেন, তারা হলেন- তাহির রাজ ভাসিন, দিব্যা দত্ত, পরেশ রাওয়াল, চন্দন রায় সান্যাল ও রাজশ্রী দেশপান্ডে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর মুভিটি ভারতজুড়ে মুক্তি পায়। মুক্তির পর চলচ্চিত্রটি ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি অনেকেই ইতিবাচক মন্তব্য করছেন।  এ ছবিতে কোনো কমফোর্টের জায়গা নেই। মর্বিডিটি যাদের শ্বাসকষ্ট ঘটায়, তারা ইনহেলার ব্যাগে পুরে সিনেমাটি দেখতে আসবেন প্লিজ! নিজের চোখে একটিবার দেখে যাবেন অবক্ষয়, ভাঙন, সৃষ্টিশীল মানুষকে কেমন কুরে কুরে খেয়ে ফেলে...।’ ৎ


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১