বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৫ September ২০১৮

ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর

রুপালি ইলিশ বাদ দিয়ে চাঁদপুরকে কল্পনা করা যায় না ছবি : তানভীর আহেমেদ সিদ্দিকী


রুপালি ইলিশের সঙ্গে চাঁদপুরের সখ্য হাজার বছরের প্রাচীন। বাংলা অঞ্চলের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রুপালি ইলিশ অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে সম্পৃক্ত। রুপালি ইলিশ বাদ দিয়ে চাঁদপুরকে কল্পনা করা যায় না। পদ্মা-মেঘনা মোহনার ইলিশ দেখতে পাতলা কোমরের রুপালি মেয়ের মতোই সুন্দর। চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনাসহ ষাটনল পর্যন্ত প্রায় ৬০ মাইল এলাকা হলো ইলিশের অভয়াশ্রম। এ অঞ্চলকে ডিম পাড়ার জন্য ইলিশের বিখ্যাত আভাসভূমি বলা হয়। তাই ‘চাঁদপুর ইলিশের বাড়ি’ ব্র্যান্ড হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ ব্র্যান্ডের জন্য জনপ্রশাসন পদকও পেয়েছে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন। প্রয়াত কবি ও গীতিকার এম ইদ্রিস মজুমদার চাঁদপুরকে নিয়ে লিখেছেন, ‘চাঁদপুর ভরপুর জলে আর স্থলে, মাটির মানুষ আর সোনার ফসলে।’ বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীবন্দর হওয়ায় বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ভারতবর্ষে চাঁদপুরের পরিচিতি ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। এটি ছিল পাট ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র। চাঁদপুরকে একসময় ব্রিটিশ ভারতের ‘গেটওয়ে টু ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ বলা হতো। ব্যবসার সুবিধার্থে ইংরেজরা ১৮৮৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলপথের চাঁদপুর শাখা নির্মাণ করেন। চাঁদপুর শহর মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি পুরান বাজার, অপরটি নতুন বাজার। পাট ও লবণ শিল্প না থাকায় পুরান বাজার ব্যবসায় ধস নামে। বর্তমানে নতুন বাজারে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। চাঁদপুরে নদীবন্দর হওয়ায় এখানে রয়েছে একটি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। যেখানে বিভিন্ন নদীতে মাছের মজুত, নতুন মাছের প্রজাতি রক্ষণাবেক্ষণ, নদীর পাঙ্গাশ, বোয়ালসহ গভীর পানির মাছ ও দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে গবেষণা করা হয়। চাঁদপুরের জনপদ প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। মেঘনা, ডাকাতিয়া ও ধনাগোদা নদীর কোলজুড়ে ১,৭০৪.০৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঘন সবুজ ভূখণ্ডের নাম চাঁদপুর। এই ভূখণ্ডে বসবাস করে প্রায় ৩০ লাখ ২৬৩ জন। বারভুঁইয়াদের আমলে চাঁদপুর অঞ্চল (কিছু অংশ) বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের দখলে ছিল। তার নামানুসারে চাঁদপুরের নামকরণ করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কারো মতে, চাঁদপুর শহরের পুরিন্দপুর মহল্লার চাঁদ ফকিরের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম চাঁদপুর।  হাজীগঞ্জের পিরোজপুর গ্রামে ফিরোজশাহী মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির অন্যতম নিদর্শন, যেটি ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দেওয়ান ফিরোজ খান লস্কর প্রায় সাতশ বছর আগে ১৩৪৪ সালে নির্মাণ করেছেন বলে শিলালিপি থেকে জানা যায়। একই স্থানে তিনি একটি বিশাল দিঘি ও ডাকাতিয়া নদী দিয়ে মসজিদে যাওয়ার জন্য একটি খাল খনন করেন, যার নাম বোয়ালজুড়ি খাল। উপজেলার অলিপুর গ্রামে প্রখ্যাত মোগল শাসক আবদুল্লাহর প্রশাসনিক সদর দফতর ছিল। এখানে ১৩৭০ সালে নির্মিত হয় বাদশাহ আলমগীরি পাঁচ গম্বুজ মসজিদ। এ মসজিদ নির্মাণের ৫০ বছর পর শাহজাদা সুজা তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এখানে মোগল আমলের বীর সেনানায়কদের শানবাঁধানো মাজার রয়েছে। ১৩৫১ সালে মেহেরপুরের শ্রীপুর অঞ্চলে এসেছিলেন হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সফরসঙ্গী বিখ্যাত অলিয়ে কামেল হজরত রাস্তি শাহ। ১৩৮৮ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার নাম অনুসারে শাহরাস্তি উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে ১৮৭৮ সালে চাঁদপুর মহকুমার সৃষ্টি হয়। চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচিত প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন রমণী মোহন রায়। ১৮৯৬ সালের ১ অক্টোবর চাঁদপুর শহরকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা থেকে পৃথক হয়ে চাঁদপুর জেলা আত্মপ্রকাশ করে। ৮টি উপজেলা, ৭টি পৌরসভা, ৯০টি ইউনিয়ন ও ১ হাজার ৩৬৫টি গ্রাম নিয়ে চাঁদপুর জেলা গঠিত।

যাদের কারণে চাঁদপুরের জনপদ সমৃদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের ১ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, বর্তমান সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, পুলিশপ্রধান জাবেদ পাটোয়ারী, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, জাতীয় অধ্যাপক এম রফিকুল ইসলাম, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ডা. সৈয়দা বদরুননাহার চৌধুরী, কবি দোনা গাজী, চারণ কবি সামছুল হক মোল্লা, গীতিকার এম ইদ্রিস মজুমদার, স্বামী স্বরূপানন্দ, সর্ববিদ্যা ঠাকুর, উপমহাদেশের নারীদের জন্য প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগম, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট আশেক আলী খান, চিত্রশিল্পী হাশেম খান ও খানবাহাদুর আবিদুর রেজা।

চাঁদপুরে পুরাকীর্তির মধ্যে রয়েছে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ, ১৩৪৪ সালে সুলতান ফখরুদ্দীন শাহের আমলে নির্মিত পিরোজপুর গ্রামের তিন গম্বুজ মসজিদ, ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত শাহ সুজা মসজিদ ও আলমগীরি মসজিদ। আটশ বছরের পুরনো শাহরাস্তির মেহের কালিবাড়ী, হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর হজরত শাহরাস্তি (রহ.) মাজার শরিফ, পাঁচশ বছরের প্রাচীন একটি রাজবাড়ি রয়েছে শাহরাস্তি উপজেলার সাহাপুর গ্রামে।

একসময় ফরিদগঞ্জ ও চাঁদপুর সদর উপজেলা তীরবর্তী এলাকায় প্রচুর নীল চাষ হতো। ১৮৭৩ সালে এ অঞ্চল থেকে নীলচাষিরা বিদায় নেন। বেশিরভাগ নীলকুঠি এখন মেঘনাগর্ভে বিলীন হলেও ফরিদগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জে এখনো কিছু নীলকুঠি দেখা যায়। এখানে রয়েছে ১২৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কচুয়ার ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ মন্দির, হিন্দু সম্প্রদায়ের পবিত্র মনাসা মুড়া। উপজেলার সাচারে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ রথ অনুষ্ঠিত হয় এবং উজানী গ্রামে রয়েছে ১৭৭২ সালে নির্মিত প্রাচীন বখতিয়ার খাঁ মসজিদ। জানা যায়, উজানীর এই গ্রামেই বেহুলা-লখিন্দরের লোহার তৈরি বাসরঘর ছিল। এ গ্রামেই পুঁথি সাহিত্যের অমর রচয়িতা দোনা গাজীর কর্মস্থল ছিল। মতলবের বদরপুরে রয়েছে শাহ সুলতান সোলাইমান ল্যাংটার মাজার।  জেলার প্রসিদ্ধ খাবারে তালিকায় রয়েছে পদ্মার ইলিশ, হাজীগঞ্জের কৈয়ারপুলের হাতে ভাজা গিগজের মুড়ি, গাউছিয়া হাইওয়ে হোটেলের খাঁটি দুধের তৈরি মালাইকারী, মতলবের ক্ষীর, ফরিদগঞ্জের আউয়ালের মিষ্টি, কচুয়ার প্যারা সন্দেশ।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১