আপডেট : ১১ August ২০১৮
গান্ধি, জিন্নাহ ও মুজিবের একটা তুলনা করেছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। গান্ধি ও জিন্নাহর কোটি কোটি ভক্তের কেউই এঁদেরকে নিজেদের একজন ভাবতে পারত না। শেখ মুজিবের অনুরাগীরা কিন্তু সবসময়েই তাঁকে নিজেদের একজন মনে করত। তাঁর সরল জীবনযাপন এই ভাবমূর্তি গঠনে সহায়তা করেছে, তার চেয়েও বেশি করেছে তাঁর ভাষা। তাঁর প্রাত্যহিক ব্যবহারের ভাষায় যেমন প্রমিত বাংলা আর আঞ্চলিকতার মিশেল ছিল, বক্তৃতার ভাষায়ও তা-ই। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ আমি যতবার শুনেছি, ততবারই কথাটা আমার মনে হয়েছে। ‘আমি যদি তোমাদের আর হুকুম দেবার নাও পারি’র মতো বাক্যাংশ বক্তার হূদয়নিঃসৃত বলেই সরাসরি শ্রোতার বুকে এসে বাজে। সে বুঝতে পারে, ইনি আমাদেরই লোক। তবে শুধু ভাষা দিয়েই হয় না। পাকিস্তানের ঊষালগ্ন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আত্মত্যাগের যে-ইতিহাস তাঁর, তারও তুলনা বেশি নেই। কোনো অবস্থাতেই তিনি আপস করেননি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন তিনি সেনাছাউনিতে বন্দি, যখন সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত, তখনো নয়। ১৯৭১-এ যখন পাকিস্তানের বন্দিশালায় কারারুদ্ধ, তাঁকে ভয় দেখাতে যখন কবর খোঁড়া হচ্ছে নির্জন প্রকোষ্ঠের পাশে, তখনো তিনি অকুতোভয়। কারাকর্তাদের কাছে তাঁর একটাই মিনতি : আমার লাশটা দেশে পাঠিয়ে দিও, বাংলার মাটিতে যেন আমার শেষ আশ্রয় হয়। দেশেরও একটা নতুন ভাবমূর্তি গড়ে দিয়েছিলেন তিনি— বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলনের সময়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন করেছিলেন, অনেকটা তেমনি। এই প্রদেশের নাম কী হবে, তা নিয়ে ১৯৫৬ সালে গণপরিষদে এবং পরিষদের বাইরে তাঁর বক্তৃতা, ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেঙে পুরোনো প্রদেশগুলি যখন স্ব স্ব নামে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো, তখন তাঁর বক্তৃতা— এসবের মধ্য দিয়ে বাংলা নামের পুনরুজ্জীবনের জন্যে তাঁর উদ্বেগ চিত্ত মথিত করার মতো। প্রথমে পূর্ববাংলা, তারপরে বাংলা, তারপরে বাংলাদেশ। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বলতে বলতে অনায়াসে বলেছেন, ‘আমি তোমায় বড়োই ভালোবাসি।’ তাতে আমরা হেসেছি অনেকে, কিন্তু তাঁর আন্তরিকতায় সন্দেহ করিনি। বাংলা তাঁর কাছে ছিল এক জাগ্রত জীবন্ত সত্তা। তার সঙ্গে তাঁর মর্মের যোগ অটুট আত্মিক সম্পর্ক। ভাষার প্রতিও তাঁর ছিল এমনি ভালোবাসা। ১৯৭১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির সভায় তিনি বলেছিলেন, পণ্ডিতেরা বসে বসে পরিভাষা তৈরি করুন— আমরা তার জন্যে বসে থাকব না। যেদিন আমরা ক্ষমতায় আসব, সেদিন থেকেই সব কাজে বাংলার ব্যবহার শুরু করে দেবো। তিনি জানতেন কি না কে জানে, ইন্দোনেশিয়ায় ঠিক এমনি করেই সরকারি কাজে ও শিক্ষাক্ষেত্রে বাহাসা ইন্দোনেশিয়ার প্রচলন শুরু হয়। রাতারাতি, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই, এক কলম সরকারি নির্দেশের ফলে। গোড়ায় সবকিছুতে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ ওলন্দাজ শব্দ ব্যবহূত হয়েছে, তারপর বাহাসা ধীরে ধীরে সেসবের জায়গা নিয়েছে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল তাঁর মজ্জাগত। ভালোবাসার সঙ্গে দায়িত্ববোধ। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তখন সদ্য গঠিত হয়েছে। ঢাকায় তাদের প্রথম জনসভা পল্টন ময়দানে। আওয়ামী লীগের লোকেরা ইট-পাটকেল ছুড়ে সভা পণ্ড করে দিলো। ইটের এক টুকরো আমার এক বন্ধুর মুখে এসে পড়ে, আহত অবস্থায় তাকে ভর্তি হতে হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। খানিক পরে শেখ মুজিব হাসপাতালে এলেন আহতদের দেখতে। আমার বন্ধুর বাড়ি শরিয়তপুরে, তার বড় ভাই শেখ মুজিবের বন্ধুস্থানীয়। সে তো শেখ সাহেবকে দেখে ‘মুজিবর’ আর ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে তিরস্কার করতে থাকল। শেখ মুজিব একটু হেসে ‘তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ্’ বলে ওকে ছেড়ে পরের বিছানার রোগী দেখতে গেলেন। কোনো প্রত্যুত্তর নয়, কোনো ভর্ৎসনা নয়। এত মানুষকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এবং মনে রাখতেন, এ কে ফজলুল হক ছাড়া আর কোনো নেতার মধ্যে এমনটা দেখিনি। কেউ তাঁর কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো নয়, সবারই প্রাতিস্বিক মূল্য আছে তাঁর কাছে, সবাই ভালোবাসার যোগ্য। এটা হয়তো অবিমিশ্র গুণ নয়। যাঁর প্রতি কঠোর হওয়া উচিত, তাঁর প্রতিও যথেষ্ট সদয় হয়েছেন। সবাইকে যে বিশ্বাস করেছেন, তাতে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে তাঁরই। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলিতে গোয়েন্দা বিভাগের এক এসপি তাঁর কাছে গিয়েছিলেন তাঁকে সতর্ক করতে। তিনি তাঁকে বলেন, ‘ওরে, পাকিস্তান আমলে তোরা আমার বিরুদ্ধেও কত কথা বানিয়ে লিখেছিস। এখন এসেছিস আবার এইসব রিপোর্ট দেখাতে। যা, এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাস না। কোনো বাঙালি আমার গায়ে হাত দেবে না।’ এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ৩২ নম্বরের বাড়িতে তিনি থেকে গেলেন শিথিল নিরাপত্তা-ব্যবস্থায়, বঙ্গভবনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় গেলেন না। তাতে সুবিধে হলো ঘাতকদের। অনেক সহজে তারা সম্পন্ন করতে পারল ইতিহাসের এক চরম ট্র্যাজেডিকে। ওই আত্মবিশ্বাসের ছিদ্রপথেই শনি ঢুকল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষের পক্ষে এটাই ছিল স্বাভাবিক। যে-বাঙালিকে তিনি ভালোবেসেছেন, যে-বাঙালিকে তিনি মুক্ত করেছেন, যে-বাঙালিকে তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন নতুন জীবনের, তাকে বিশ্বাস না করে পারতেন কী করে! ৎ
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১