বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৪ August ২০১৮

বৈশাখ ও রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংরক্ষিত ছবি


তুষার প্রসূন

যা কিছু পুরনো, সে সব বিদায় দিয়ে বৈশাখ সাড়ম্বরে বরণ করে নতুনকে। প্রচণ্ড ঝড় নিয়ে এসে বৈশাখ বিদায় নেয় ধ্বংসের সহযাত্রী হয়ে। বৈশাখ সবসময় সাহসী, ক্ষ্যাপা, বৈরী, অশান্ত, অসীম, নির্দয় কিন্তু তার সৃজনক্ষমতা শিল্পীর নিপুণ আল্পনাকেও হার মানিয়ে দেয়, তার নবায়নী ধারা প্রকৃতিকে ঋদ্ধ করে অপার ব্যঞ্জনায়। মানুষ তখন ভেবে পায় না তাদের মনে কেন এত নবআনন্দের জোয়ার, কেন এত নতুন লাগে নিজেকে! সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আমাদের মাঝে এলেন এক বৈশাখে, প্রেম, প্রকৃতি আর মানুষের জয়গান সাথে করে, বাংলাকে পূর্ণতা দিতে। ‘বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ’ প্রাসঙ্গিক, নাকি ‘রবীন্দ্রনাথের বৈশাখ’ নিয়ে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক তা একজন বাঙালির পক্ষে নির্ণয় করা কঠিন। তারপরও প্রথমে দেখা যাক ‘বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ’-এর ভূমিকা নিয়ে। ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব মাসকেই উপস্থাপন করেছেন অনন্য বৈশিষ্ট্যে। বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ সেই বৈচিত্র্যেরই একটা অংশ যা মানুষের মাঝে তিনি উপস্থাপন করেছেন বিশেষ দর্শন বা উদ্দেশ্য সামনে রেখে। বৈশাখ ও বাঙালি সংস্কৃতি অভিন্ন ক্যানভাসে চিত্রিত বাঙালির উৎসব। বাড়ির পাশের শিশির বিন্দু থেকে শুরু করে পৃথিবীর পথে পথে রবীন্দ্রনাথ যত অব্যক্ত ভাব অনুভব করেছেন, তিনি তা-ই নান্দনিক ভাষায় মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। কোনো কিছুই যেন তার দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করেনি। বাঙালি ঐতিহ্যের প্রাচীনতম ধারাবাহিকতায় বাউল, জারি সারি, কীর্তন আবহমান কাল ধরে বাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে চলে এলেও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের পর ঋতুবৈচিত্র্যের ধারাবাহিকতায় বয়ে আসা বৈশাখ উদযাপন অনেকটা বদলে গেছে। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ বৈশাখে জন্মেছিলেন বলেই হয়তো তার এই মাসটির প্রতি রয়েছে বিশেষ টান; অন্যদিকে ঋতুবৈচিত্র্যের এই বাংলায়, বাঙালির আবহমান কালের প্রথাগত সংস্কৃতি-পুরনোকে পেছনে ফেলে নতুনকে বরণ করার নতুনতর দাবি নিয়ে বৈশাখ আসে বলেই বাংলা সনের প্রথম মাসটি কবির এত প্রিয়। বৈশাখ পালনের বিভিন্ন রকম আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের মতো করে পালনের মাধ্যমে দিনটিকে আরো মহিমান্বিত করেছেন, যার ধারাবাহিকতা আমরা এখনো কণ্ঠ মিলিয়ে স্মরণ করি দৃঢ়তার সঙ্গে।

১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ২০-এ ফাল্গুনে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ গানের মধ্য দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল বৈশাখকে। কাহারবা তালের এই গানটি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিভাবনার নিপুণ এক নির্মাণ। গানটিতে সুর ও বাণীর অপূর্ব মেলবন্ধন থাকায় তা বাঙালিচিত্তকে একসুতোয় গেঁথে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের বৈশাখী গানের ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ চরণটি যেন সমস্ত বাঙালির প্রাণের কথা হয়ে ধরা দিয়েছে। কবি চেয়েছেন মৃত, পচা, জরা, ব্যাধি সবই বৈশাখী বাতাসে উড়িয়ে দিতে, চেয়েছেন অগ্নিস্নানে সবকিছু শুচিস্নিগ্ধ করতে। তিনি বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে মেতে উঠতে চেয়েছেন নবসৃষ্টির আনন্দে। শুধু একটি গানেই নয়, তিনি ‘কল্পনা’ কাব্যের ‘বৈশাখ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ/ ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল/ তপ্তঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষান ভয়াল/ কারে দাও ডাক-/ হে ভৈরব হে রুদ্র বৈশাখ?’

এবার আসা যাক ‘রবীন্দ্রনাথের বৈশাখ’ প্রসঙ্গে। বলা হয়েছিল, বৈশাখ মাসে যেহেতু রবীন্দ্রনাথের জন্ম (২৫ বৈশাখ ১২৬৮), তাই কবির রয়েছে বৈশাখ মাসটির প্রতি একটু বিশেষ টান। ফলে তিনি অনেক কবিতা ও গানে বৈশাখ মাসকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। যদিও ১৯৩৬ সাল থেকে বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন প্রবর্তিত হয়। ফলে বর্ষবরণ কিংবা জন্মদিনবরণ একটি ভিন্নরূপ লাভ করে। রবীন্দ্রনাথই যে শুধু রচনা করে গেছেন তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও যে কত গান-কবিতা-ভাষণ রচিত হয়েছে, তার ঠিক নেই। বিশিষ্ট রবীন্দ্র-বঙ্কিম গবেষক অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘বাঙালীর গর্বিত সংস্কৃতির ইতিহাসে বেঁচে আছে দু’তিনটি বাংলা তারিখ, ১লা বৈশাখ, ২৫শে বৈশাখ, ২২শে শ্রাবণ, ৭ই পৌষ (শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যপ্রাচীন পৌষমেলা)। এর মধ্যে তিনটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাপুরুষটিকে ঘিরে।’

রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম দিনগুলোতে ২৫ বৈশাখ তেমন জাঁকজমকভাবে পালিত হয়নি। তার ২৫ বছর বয়সে জন্মদিন পালনের কথা জানা যায়। একটি চিঠিতে তিনি তার বন্ধু ও সাহিত্য সমালোচক শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখেছিলেন, ‘আজ আমার জন্মদিন-পঁচিশে বৈশাখ-পঁচিশ বছর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে ধরণীতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম, জীবনে যেন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন।’ এরপরও যে তার জন্মদিন খুব আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে পালিত হয়েছে এমন নয়। তার বহু জন্মদিন ঠাকুরবাড়ির আঙিনাতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার জীবনে বিদেশ ভ্রমণ অনেকটা সময় দখল করে থাকায় তাকে অনেক সময় বিদেশেও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছর বয়সে পদার্পণ উপলক্ষে প্রথমবারের মতো খুব সাড়ম্বরে তার জন্মদিবস পালিত হয়। এ ছাড়া ১৯২১ সালে কবি ইউরোপ আমেরিকা ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরলে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে তার জন্মোৎসবে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রঙে আমাদের রাঙিয়ে গেছেন। তিনি নিয়েছেন যত, দিয়েছেন তারও বেশি। তাই তার কাছে আমরা চিরঋণী। বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের বৈশাখ দুটি অভিন্ন বিষয়, বলা যায় একে অপরের পরিপূরক। আজ ২২ শ্রাবণের সম্মুখ শিয়রে দাঁড়িয়ে তাই জন্মদিনের কথাই বললাম। আরেক কবির ভাষায় শেষ করি, ‘কে হায় হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে।’  ৎ

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১