বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৯ July ২০১৮

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম সংরক্ষিত ছবি


রাজধানী ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। দেশের প্রধান ও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে হাজারো মুসল্লির সমাগম ঘটে এই মসজিদে। মসজিদটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, বর্তমান অবস্থাসহ মসজিদকেন্দ্রিক বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে আজকের আয়োজনটি সাজিয়েছেন মিরাজ রহমান, সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন ও ওয়ালি উল্লাহ সিরাজ

বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র পল্টন এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। নগরজীবনে শত ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে আত্মার প্রশান্তি ও পরকালীন মুক্তির আশায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের জন্য দেশের বৃহত্তম এই মসজিদে ছুটে আসেন। পবিত্র কাবা শরীফের আদলে তৈরি করা এই মসজিদটির দিকে তাকালে নিমিষেই যেন পৃথিবীর সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মসজিদটির সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত নকশা যেকোনো স্থাপনাকে হার মানায়। প্রতিষ্ঠার ইতিহাস : তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বিশিষ্ট শিল্পপতি আবদুল লতিফ ইবরাহিম বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে প্রথমে মসজিদটি নির্মাণের পদক্ষেপ গৃহীত হয়। অবশ্য লতিফ বাওয়ানিই প্রথম ঢাকাতে বিপুল ধারণক্ষমতাসহ একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয় বিশিষ্ট স্থপতি টি. আবদুল হুসেন থারিয়ানিকে। পুরো কমপ্লেক্স নকশার মধ্যে অফিস, দোকান, লাইব্রেরি ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারপর ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রথম পর্বের নির্মাণকাজ শেষ হয় (কোথাও কোথাও ১৯৬২ সালের কথা উল্লেখ আছে)। একই বছরের ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার বায়তুল মোকাররম মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয় এবং পরদিন শনিবার তারাবির জামাত অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে মসজিদটিতে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের নকশা ও ডিজাইন : মসজিদটির প্রধান ভবনে সাদা রঙের ব্যবহার ও প্রায় ‘কিউবিক’ আকৃতির অবকাঠামোসহ সমগ্র নকশাটিতে নির্মাণকালীন স্থাপত্যিক প্রভাব প্রতিফলিত হয়। মসজিদটির প্রধান কক্ষের ছাদে গম্বুজের অনুপস্থিতি মসজিদ স্থাপত্যের একটি বিরল বৈশিষ্ট্য। তবে উত্তর ও দক্ষিণ দিকের প্রবেশ বারান্দার ওপর দুটি ছোট গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধান ভবনটি আটতলা এবং মাটি থেকে ৩০.১৮ মি. উঁচু। মূল নকশা অনুযায়ী মসজিদের প্রধান প্রবেশপথ পূর্ব দিকে। পূর্বের সাহানটি ২৬৯৪.১৯ বর্গমিটার এবং এর দক্ষিণ ও উত্তর পাশে অজুর জন্য জায়গা রয়েছে। মসজিদে প্রবেশের বারান্দাগুলোতে রয়েছে তিনটি অশ্বখুরাকৃতি খিলানপথ, যার মাঝেরটি পার্শ্ববর্তী দুটি অপেক্ষা তুলনামূলক বড়। দুটি উন্মুক্ত অঙ্গন প্রধান নামাজ কক্ষে আলো ও বাতাসের চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তিন দিকে বারান্দায় ঘেরা প্রধান নামাজ কক্ষটির আয়তন ২৪৬৩.৫১ বর্গমিটার, মধ্যবর্তী তলার আয়তন ১৭০.৯৪ বর্গমিটার এবং প্রধান নামাজ কক্ষের মিহরাবটি আয়তাকার। জানা যায়, বায়তুল মোকাররম মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে সরকার ৮.৩০ একর জমি বরাদ্দ দেয়। মসজিদের আয়তন ৬০ হাজার বর্গফুট। নিচ তলায় বিপণিবিতান ও গুদামঘর, প্রথম তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত রয়েছে ভবন বা ইমারত। মোট আট তলা হলেও সাধারণত ব্যবহূত হচ্ছে ছয় তলা। মুসল্লিরা মসজিদটির যে জায়গা ব্যবহার করে থাকে, তা হলো পুরুষদের নামাজের জায়গা প্রথম তলা ২৬,৫১৭ বর্গফুট। দ্বিতীয় তলার আয়তন ১০,৬৬০ বর্গফুট। তৃতীয় তলার আয়তন ১০,৭২৩ বর্গফুট। চতুর্থ তলার আয়তন ৭,৩৭০ বর্গফুট, পঞ্চম তলার আয়তন ৬,৯২৫ বর্গফুট এবং ষষ্ঠ তলার আয়তন ৭,৪৩৮ বর্গফুট। জুমা-ঈদ উপলক্ষে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় বাড়তি ৩৯,৮৯৯ বর্গফুট। মহিলাদের নামাজের জায়গা হিসেবে বরাদ্দ রয়েছে ৬,৩৮২ বর্গফুট। পুরুষদের অজুখানার জন্য ব্যবহূত হয় ৬,৪২৫ বর্গফুট এবং মহিলাদের অজুখানার জন্য ব্যবহূত হয় ৮৮০ বর্গফুট। সব মিলিয়ে মুসল্লিরা বায়তুল মোকাররম মসজিদের ১ লাখ ২৫ হাজার ৬২ বর্গফুট এলাকা ব্যবহার করে। মসজিদটির প্রবেশপথ পার্শ্ববর্তী সড়ক হতে ৯৯ ফুট উঁচু। বর্তমান অবস্থা : বায়তুল মোকাররম মসজিদটি স্থাপত্যিক রীতিতে আধুনিক হওয়ায় অলংকরণের আধিক্য এড়িয়ে গেলেও প্রচলিত মসজিদ স্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যকে এড়িয়ে যায়নি। স্থপতি টি. আব্দুল হুসেন থারিয়ানির মূল নকশায় মসজিদের মিনারটি ভবনের দক্ষিণ পার্শ্বে আলাদা একটি কাঠামো হলেও পরে নতুন প্ল্যান অনুযায়ী দুটি নতুন মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটির উত্তর গেট পূর্ব থেকেই কারুকার্যখচিত গেটের সমন্বয়ে নির্মিত। মসজিদটির দক্ষিণ চত্বর বর্তমানে অত্যাধুনিক ডিজাইনে নির্মিত তোরণের মধ্যে বিশাল উন্মুক্ত পরিসর, যা এক সময় পানির ফোয়ারা ছিল। বর্তমানে মসজিদটির প্রধান আকর্ষণ হলো এর সুউচ্চ মিনার, যা আমাদের দেশে প্রচলিত ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। মসজিদটির উত্তর এবং দক্ষিণ পাশে থাকা বড় হরফে ‘আল্লাহু আকবার’ লেখাটি রাতে মসজিদের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বের বৃহৎ মসজিদের তালিকায় বায়তুল মোকাররম : নানা সময় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিশ্বের বৃহৎ মসজিদের জরিপ করা হয়েছে। জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উইকিপিডিয়া, দ্য ওয়ান্ডারস ও র্যাঙ্কার.কম অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার জরিপে বিশ্বের বৃহৎ মসজিদের তালিকায় বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের নামও শোভা পাচ্ছে। ব্যবস্থাপনা : বায়তুল মোকাররম মসজিদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সরকারি বেতন স্কেল, পদমর্যাদা, পদবিন্যাস ইত্যাদি মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও সমান। ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন সামীম মোহাম্মদ আফজাল।


খতিব ছিলেন যারা

বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রথম খতিব ছিলেন মাওলানা আবদুর রহমান বেখুদ (রহ.)। ১৯৬৩ সালে তিনি এই মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা কারি উসমান মাদানী (রহ.)। তিনি এই মসজিদের খতিব ছিলেন (১৯৬৩-৬৪) মাত্র এক বছর। পরবর্তী খতিব ছিলেন মুফতি সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান। তিনি ১৯৬৪-৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, মুফতি আমীমুল ইহসানকে বায়তুল মোকাররমের প্রতিষ্ঠাতা খতিব বলা হয়। এরপর এ মসজিদের খতিব হন মুফতি মাওলানা আবদুল মুইজ (রহ.)। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৪-৮৪ সাল পর্যন্ত। এরপর বায়তুল মোকাররমে দায়িত্ব পালন করেন খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.)। তিনি ছিলেন দেশবরেণ্য আলেম। ১৯৮৪-২০০৯ সাল দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা উবায়দুল হককে জাতীয় খতিব বলা হতো। এরপর এই মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করা মুফতি মাওলানা নুরুদ্দীন (রহ.) এক বছর ভারপ্রাপ্ত খতিবের দায়িত্ব পালন করেন এবং খতিব থাকাকালীন ইন্তেকাল করেন।

বর্তমান খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিন

বর্তমানে বায়তুল মোকাররম মসজিদে একজন খতিব, সিনিয়র পেশ ইমাম একজন ও পেশ ইমাম তিনজন, একজন প্রধান মুয়াজ্জিন ও দুজন মুয়াজ্জিন দায়িত্বে রয়েছেন। বর্তমানে খতিবের দায়িত্বে রয়েছেন প্রফেসর মাওলানা মোহাম্মাদ সালাহ্উদ্দিন। তিনি ৫ জানুয়ারি ২০০৯ সালে এ মসজিদের খতিব নিযুক্ত হন। এ ছাড়া সিনিয়র পেশ ইমাম হিসেবে দায়িত্বে রয়েছে মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান। পেশ ইমাম হিসেবে রয়েছেন মুফতি মাওলানা মুহিবুল্লাহিল বাকী, মাওলানা মুহাম্মদ এহসানুল হক ও মাওলানা মুহাম্মদ মহিউদ্দিন কাসেম। প্রধান মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্বরত আছেন কারি মো. মাসউদুর রহমান। এ ছাড়া মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন কারি মো. হাবিবুর রহমান ও মো. ইসহাক।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১