বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৭ June ২০১৮

বাংলার টালি

মাটির তৈরি খাঁটি সোনা

দক্ষ কারিগরের সুনিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে সুদৃশ্য টালি সংরক্ষিত ছবি


চাট্টিখানি কথা নয়, কংক্রিট বা টাইলসকে পেছনে রেখে সাতক্ষীরার মাটির তৈরি টালি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে পেরেছে। কোনো মেশিন বা যন্ত্র ছাড়াই কারিগররা তাদের সুনিপুণ হাতের স্পর্শে মাটি দিয়ে তৈরি করেন টালি। এসব টালি রোদে শুকানোর পর চুল্লিতে পোড়ানো হয়। টালি কারখানাগুলোতে এখন বছরে উৎপাদন হয় ৭০০ থেকে ৮০০ কনটেইনার। বছরে ৩০০ থেকে ৪০০ কন্টেইনার টালি মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ইটালি যায়। টালি রফতানির মাধ্যমে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার, স্টার্লিং আর ইউরো সমৃদ্ধ করছে দেশের অর্থনীতিকে। নতুন আশা জাগিয়েছে রফতানির ক্ষেত্রে। নিম্নে টালি শিল্প নিয়ে বিস্তারিত উপস্থাপন-

 

টালির কর্মযজ্ঞে ঘুরছে অর্থনীতির চাকা 

সাতক্ষীরার টালি এখন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। কারণ মাটির তৈরি টালি শুধু বিদেশিদের নজর কাড়েনি, ঘুরিয়েছে অর্থনীতির চাকা। চোখে পড়ার মতো সাফল্য। প্রতিটি পরিবারের নারী, পুরুষ ও শিশুরা কর্মব্যস্ত। টালি শিল্পকে কেন্দ্র করে জেলার কলারোয়া উপজেলায় গড়ে উঠেছে শিল্পপল্লী। কোনো মেশিন বা যন্ত্র ছাড়াই সম্পূর্ণ হাতের তৈরি টালি দখল করে নিয়েছে ইউরোপের বাজার। শুধু কলারোয়ার মুরারীকাঠির পালপাড়া নয়, সাতক্ষীরা ও কলারোয়ার আশপাশে ঝাউডাঙ্গা, তুজলপুর, ব্রজবক্স, ধুলিহর ও কাথুনদাসহ বিভিন্ন গ্রামের পালপাড়ায় নতুন প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। একে একে কলারোয়া ও তার আশপাশের পালপাড়ায় গড়ে ওঠে প্রায় দেড়শ’ কারখানা। এতে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের প্রায় সবাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। দিন দিন কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। মাটি ও পানি হচ্ছে টালি ও টাইলসের প্রধান উপকরণ।  

পারিশ্রমিক ছাড়া খরচ বলা যায় একেবারেই কম। তারপরও একটি টাইলসে সর্বসাকুল্যে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৩ টাকা। প্রতিটি টাইলস ইটালিতে বিক্রি হয় ১৭ টাকায়। কলারোয়ার পালপাড়া থেকে ট্রাকে করে টাইলস প্রথমে পাঠানো হয় সমুদ্রবন্দর মোংলায়। তারপর সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম, সিঙ্গাপুর হয়ে ইটালি ও আমেরিকায় যায় বাংলার টাইলস।  

সাধারণত বছরের ৬ থেকে ৭ মাস অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মে-জুন পর্যন্ত টালি তৈরির মৌসুম। বর্ষাকালে টালি তৈরি করা যায় না। টালি কারখানাগুলোতে অন্তত দুই হাজার শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করে। কলারোয়ার মাটির টাইলসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান- ক্লে টাইলস, কটো ইনোভেটর, আরনো এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, জেএস ট্রেডার্স, ডি. চন্দ্র পাল, নিকিতা ইন্টারন্যাশনাল ও কটো ইনোভেটর লিমিটেড। কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাঠি, শ্রীপতিপুর ও মির্জাপুর- এ তিনটি গ্রামে টালি কারখানা রয়েছে প্রায় ৩২টি। খুলনা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর থেকে ইটালি, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসে মাটির টালি রফতানি হয়। ঝিনাইদহ জেলার ছয়টি উজেলার সহস্রাধিক স্থানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় টালি আর রিং তৈরির কারখানা। দামুড়হুদার জয়রামপুরের কাঁঠাল বাগানের আশপাশে কয়েকটি টালির কারখানা গড়ে উঠেছে। চুয়াডাঙ্গা এলাকায় টালির কোনো কারখানা ছিল না। টালির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় ব্যক্তিরা টালির কারখানা গড়ে তুলেছেন। প্রতিবছর কলারোয়ায় উৎপাদিত টালি রফতানি করে অর্জিত হচ্ছে পাঁচ-ছয় কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। 

টালি তৈরির ইতিকথা 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে সাহেবদের কুঠি, অফিস কিংবা বাসভবনের পাকা দালানের একটি চূড়া থাকত টালির, যা ব্রিটেনের প্রাচীন স্থাপত্যে এখনো দৃশ্যমান। বাংলাদেশ থেকে টালি উৎপাদক মৃৎশিল্পীরা চলে গেলেও দেশের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার কলারোয়ায় মৃৎশিল্পীরা বাঁচিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্যবাহী টালি শিল্প। ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা দেশে এমন বাড়ি খুব কমই ছিল, যে বাড়িতে ছিল না দু-একটি টালির ঘর। দামে সস্তা হওয়ায় ছন আর খড়ের পরই ছিল টালির স্থান। গ্রীষ্মকালে টালির ঘর ছিল সবচেয়ে ঠান্ডা এবং আরামপ্রদ। কিন্তু নানা কারণে ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে টালি তৈরির সঙ্গে যুক্ত মৃৎশিল্পীরা দেশ ত্যাগ করলে ঐতিহ্যবাহী টালি শিল্প প্রায় বিলুপ্তই হয়ে যায়। জানা গেছে, কলারোয়ার পালপাড়ার স্থানীয় পাল-সম্রাট সতীশ চন্দ্র পাল ১৯৫২ সালের দিকে ঘরের ছাউনির টালি তৈরির গোড়াপত্তন করেন। সেখান থেকেই মৃৎশিল্পীদের বিস্তৃৃতি ঘটে। সতীশ চন্দ্র স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মারা গেলে তার পরিবারসহ মৃৎশিল্পীদের ব্যবসায় ধস নামে। অভাবের তাড়নায় অনেকেই পৈতৃক পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হন। কালপরিক্রমায় ঘুরে দাঁড়ান মৃৎশিল্পীরা। ২০০৩ সালের দিকে ইটালির নকশা অনুযায়ী কাদামাটি কাঠের ফ্রেমে ঢেলে তা রোদে শুকিয়ে টালির মতোই বাংলার টাইলস তৈরি করে বিপ্লব ঘটান মৃৎশিল্পীরা। ওই বছর থেকেই ইটালিতে বাংলার টাইলস রফতানি শুরু হয়ে এখন আমেরিকা ছাড়িয়ে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে যাচ্ছে। 

সাতক্ষীরা থেকে ইটালি নগর 

সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী কলারোয়া উপজেলা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে মুরারীকাঠি গ্র্রাম। মুরারীকাঠি-শ্রীপতিপুরে মাটির কারিগররা গড়ে তুলেছেন বাহারি টালির এক সাম্রাজ্য। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০২ সালের প্রথম দিকে ইতালীয় ব্যবসায়ী রাফাইলো আলদো আসেন বাংলাদেশে। দেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে তিনি নারায়ণগঞ্জে টালি তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু ওই এলাকার মাটি টালি তৈরির উপযুক্ত না হওয়ায় ইটালিতে ফিরে যান। রাফাইলো ফিরে গেলেও তার প্রতিষ্ঠিত টালি কোম্পানির ম্যানেজার রুহুল আমিন দেশের বিভিন্ন স্থানে পোড়ামাটির টালি তৈরির জন্য মাটি খুঁজতে থাকেন। পরে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাঠি এলাকায় টালি তৈরির উপযুক্ত মাটির সন্ধান পান তিনি। রুহুল আমিনের উদ্যোগেই ২০০৩ সালের প্রথম দিকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় টালি তৈরির কাজ। ওই বছরই কলারোয়া থেকে প্রথম ইটালিতে টালি রফতানি হয়। ইটালিতে ব্যাপক পরিমাণে টালি রফতানির কারণে কুমারপাড়া এখন ইটালি নগর নামেই অধিক পরিচিত। 

বাংলার টাইলস ইউরোপের বাজারে 

ভাবতে অবাক লাগে, বিদেশিদের কাছে টাইলসের কদর বাড়ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ডিজাইনের টাইলস অর্ডার দিচ্ছে ইটালি ও আমেরিকার আমদানিকারকরা। ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশও বাংলার টাইলস আমদানির চিন্তা-ভাবনা করছে। বিদেশিরা আমদানির পর পোড়া মাটির টাইলসে বিশেষ একধরনের কেমিক্যাল লাগিয়ে রঙ উজ্জ্বল করে মজবুত ও টেকসই আধুনিক টাইলস হিসেবে ব্যবহার করছে। এই টাইলস সিরামিক টাইলসের মতোই মেঝে ও দেয়ালে ব্যবহার করা যায়। ভেবে দেখুন একবার- কত গর্বের কথা, ইটালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এদেশের মাটি দিয়ে গড়া টালি মেঝে, ছাদে, দেয়ালে টাইলস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। টালি রফতানি আয়ের পাশাপাশি দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিল্প তুলে ধরেছে বিশ্বদরবারে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পর্যাপ্ত পুঁজি, ভালো বাজারদর, জ্বালানি কাঠের নিশ্চয়তা পাওয়া গেলে দেশের মাটির তৈরি টালি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে রফতানি করা সম্ভব। সরকারের অনুপ্রেরণায় দেশেও টালির তৈরি বাড়িঘর নির্মাণ বাড়ানো সম্ভব। হাতের তৈরি এই টালিতে আরো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে দেশে নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে কারুকার্যময় টাইলস হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের অভ্যন্তরেও বড় বাজার সৃষ্টি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। 

লেখক : কলাম লেখক ও উন্নয়ন গবেষক 

writetomukul36@gmail.com


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১