বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৮ April ২০১৮

আলোক দূষণের কবলে প্রকৃতির রূপ ও স্বভাব


সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে আরো আগে। শরতের ঝকঝকে আকাশে অসংখ্য তারা, সাদা বেলুনের মতো নিটোল গোলগাল চাঁদটি টিনের চালের ঠিক উপরেই যেন উড়ছে। উঠোনে খেজুর পাতার চাটাই পেতে বসেছে কিসসার আসর। কথক সুর করে করে শুনিয়ে যাচ্ছে রূপকথা আর প্রাগৈতিহাসিক সব গল্প। শ্রোতারা তাকে ঘিরে চাঁদের আলোয় ভিজতে ভিজতে হারাচ্ছেন কল্পনার জগতে।

গ্রাম-বাংলার এক সময়কার নিত্য দৃশ্য ছিল এটি। কিন্তু কথিত সভ্যতার জাঁতাকলে পিষ্ট সেসব চাঁদনী রাত, সেসব অপার্থিব ক্ষণ। বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিতে ঝাপসা হয়ে গেছে রাতের আকাশ।

আলো দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও প্রকৃতির জন্য অন্ধকারেরও দরকার আছে। কিন্তু মানুষ রাতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে আজ ব্যাহত করছে বিভিন্ন আলোকপ্রযুক্তির অতিব্যবহারে।

আর এর কারণে ব্যাঘাত ঘটছে স্নায়ুর শৈথিল্য আর ঘুমের। অতি আলোর কারণে জৈবিক ঘড়ি তথা বায়োলজিক্যাল ক্লক বিঘ্নিত হচ্ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ-শ্বসনের মতো ক্রিয়াও।

ইতালীয় বিজ্ঞানী এবং আলোক দূষণ প্রতিরোধকর্মী ড. ফ্যাবিও ফালকি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা ৬০ ভাগ ইউরোপিয়ান, ৮০ ভাগ উত্তর আমেরিকান এবং বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ রাতের আকাশে আপন গ্যালাক্সি দেখতে পারেন না।

২০১৬ সালে প্রকাশিত পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের সম্পূর্ণ এবং কুয়েত, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আর্জেন্টিনার প্রায় সবটুকু আকাশ এতই উজ্জ্বল যে, সেখানে কখনোই রাতে অন্ধকার নেমে আসে না। জার্মানি, হংকং, বেলজিয়ামের নানা অংশ এবং বোস্টন, লন্ডন, ওয়াশিংটন, প্যারিসের কোনো মানুষও পরিষ্কার রাত দেখার সুযোগ নেই।

গবেষকদের মতে, মানবসৃষ্ট আলোর কারণেই বিশ্বের ৮০ ভাগ এবং পাশ্চাত্যের সম্পূর্ণ আকাশই দূষিত।

রাতে পৃথিবীতে আলো নিয়ে করা নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর পৃথিবীতে কৃত্রিম আলো আগের তুলনায় উজ্জ্বল ও তীব্র হচ্ছে।

অনেক উপর থেকে রাতে পৃথিবীতে আলো জ্বলতে দেখা যায়-২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এসব অঞ্চল প্রতিবছর ২ শতাংশ হারে বিস্তৃত হয়েছে।

আলোক দূষণ

রাতের স্বাভাবিক ধর্মকে বিনষ্ট করে আলোর পরিকল্পনাহীন ব্যবহারই আলোক দূষণ নামে পরিচিত। ভিন্ন কথায় আলোক দূষণ বলতে অতিরিক্ত কৃত্রিম আলোর ক্ষতিকর প্রভাবকে বুঝায়; যা অপর্যাপ্ত, অনিয়ন্ত্রিত এবং ক্ষেত্র বিশেষে অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট নানা সমস্যাকে নির্দেশ করে।

আন্তর্জাতিক রাত্রির-আকাশ বিষয়ক সমিতির সংজ্ঞা মতে, তপ্ত আকাশ, তীব্র আলো, আলোর অনুপ্রবেশ, বিশৃঙ্খল আলো, রাতের অপ্রতুল দৃশ্যমানতা এবং শক্তির অপচয়সহ যেকোনো ধরনের কৃত্রিম আলোর ক্ষতিকর প্রভাবকে আলোক দূষণ বলে গণ্য করা হবে। কৃত্রিম আলো যখন রাত্রিকালের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অনুপ্রবেশ করে তখনই ঘটে আলোক দূষণ। এটি নগর এলাকায়ই বেশি প্রকট যেখানে শহুরে বাতিগুলো রাতের তারা ও গ্রহগুলোকে অদৃশ্য করে দেয়। উপগ্রহ ছবিতে রাতের নাগরিক এলাকার চারদিক দূষিত আলোর তপ্ত প্রতিবেশ হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

আলোক দূষণের কারণ

বাহ্যিক আলোর ঊর্ধ্বমুখী বা পার্শ্বমুখী পরিচলনের ফলে আলোর দূষণ ঘটে যেখান থেকে আলো বায়ুমণ্ডলে যায় এবং আবার ভূমিতে ফিরে আসে। বায়ুমণ্ডলের কণিকাগুলো আলোর বিচ্ছুরণ ত্বরান্বিত করে আলোক দূষণকে তীব্র আকারে পরিণত করে। আন্তর্জাতিক রাত্রির-আকাশ বিষয়ক সমিতির মতে, নীল আলোর অধিকতর আলোক বিচ্ছুরণ ক্ষমতার কারণে যেসব উৎস নীল আলো নিঃসরণ করে সেগুলোই রাতের আকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে আলো ব্যবহার করি তাও আলোক দূষণের একটি অন্যতম কারণ।

বৈরী প্রভাব

আলোক দূষণের ফলে প্রকৃতিকে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্কাইগ্লো, লাইট ট্রেসপাস, গ্লেয়ার, ক্লাটার এবং ওভার ইলুমিনেশন উল্লেখযোগ্য।

অরক্ষিত কিংবা ঊর্ধ্বমুখী আলোক উৎস থেকে আলো বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্প ও অন্যান্য কণার মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সম্পূর্ণ আকাশই অত্যন্ত উজ্জ্বল (স্কাইগ্লো) দেখায়, যা অনেক দূর থেকেও পরিলক্ষিত হয়। এই দীপ্তির কারণে রাতের আকাশ প্রায় দিনের মতোই উজ্জ্বল হয় এবং চাঁদ-তারা কিছুই দেখা যায় না।

আপনার ঘরে আলোর অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশকে বলে লাইট ট্রেসপাসের ফলে শান্তিভঙ্গ কিংবা ঘুমের অসুবিধা হতে পারে, হতে পারে মেজাজ খিটখিটে রোগও।

আমাদের চোখে যদি হঠাৎ করেই অত্যুজ্জ্বল আলো বা গ্লেয়ার এসে পড়ে তবে তা আমাদের দৃষ্টি ব্যাহত করতে পারে, দেখার ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে এমনকি ক্ষণিকের জন্য অন্ধও করে দিতে পারে।

অতিরিক্ত আলোকিত এলাকায় বিভিন্ন রঙের আলোর মাত্রাতিরিক্ত উজ্জ্বল এবং জমকালো সমাবেশকে লাইট ক্লাটার (আলোক-বিশৃঙ্খলা) বলে। রাস্তার চারদিকে অত্যুজ্জ্বল বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড থাকলে কোনো ড্রাইভার বিভ্রান্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। প্লেন চালানোর সময় পাইলট শহরের বাণিজ্যিক আলোক সমাবেশের সঙ্গে সেফটি লাইটের আলো গুলিয়ে ফেলতে পারে, যা মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।

আলোর অত্যধিক ব্যবহার ওভার ইল্যুমিনেশন নামে পরিচিত। দেখা গেছে, কৃত্রিম আলোর জন্য যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহূত হয় তার শতকরা ৩০-৬০ ভাগই অপ্রয়োজনীয়।

আসলে শুধু ওভার ইল্যুমিনেশনই নয়, সকল প্রকার আলোক দূষণেই বিপুল পরিমাণ শক্তির অপচয় হয়। ২০০৫ সালের এক হিসাব অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বের উৎপাদিত বিদ্যুতের এক চতুর্থাংশ শুধু আলো জ্বালাতেই ব্যয় হয়।

শুধু তাই নয়, কৃত্রিম আলোর জন্য যে শক্তি ব্যয় হয় তার প্রায় ত্রিশ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে প্রতিবছর তিন কোটি ব্যারেল তেল এবং ৮২ লাখ ব্যারেল কয়লার অপচয় ঘটে, ক্ষতি হয় ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের এবং প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ টন CO2 নির্গত হয়, যা শোষণ করতে সাড়ে ৮৭ কোটি গাছের প্রয়োজন।

আলোক দূষণের জন্য শুধু শক্তির অপচয়ই হয় না; তা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যেমন মহাকাশ পর্যবেক্ষণকে অনেক কঠিন করে তোলে। চারপাশে আলোর অত্যধিক ব্যবহারে সম্পূর্ণ আকাশই উজ্জ্বল হয়ে যায়, ফলে কোনো অস্পষ্ট গ্রহ-নক্ষত্র দেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

প্রত্যেক মৌলেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমূলক বর্ণালী আছে, সুতরাং মহাবিশ্বের কোনো বস্তুর বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে তার ভর, উপাদান, তাপমাত্রা, ঔজ্জ্বল্য ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়। ফলে তা কি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু, নিউট্রন-স্টার নাকি অন্যকিছু তা বোঝা সম্ভব হয়। জ্যোতির্বিদ্যায় এই যন্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কৃত্রিম আলো বর্ণালীতে উজ্জ্বল আলোক রেখার সৃষ্টি করে যা অন্যান্য লাইনকে ম্লান করে দেয়।

আসলে দিনের আলো এবং রাতের আঁধারের সঙ্গে ভারসাম্য গড়ে উঠেছে প্রাণীর প্রাকৃতিক কারণেই। দিনে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, কাজকর্ম ও চলাচল বাড়ে, মেলাটনিন থাইরোট্রপিন গ্রোল্যাকটিন ও কর্টিকোট্রপিন ইত্যাদি হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। রাতে শরীরের তাপমাত্রা ও রক্তচাপ কমে যায় এবং মেলাটনিলসহ অন্য কিছু হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়।

জীবজগতে বেশকিছু কীটপতঙ্গ এবং অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী রয়েছে, যারা পুরোপুরি উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। এমনকি, তাদের বাসস্থান এবং খাদ্য উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে আসে। অনেক উদ্ভিদ আছে যাদের ফুল রাতে ফোটে। রাতের অন্ধকারেই কীটপতঙ্গরা ফুলে গিয়ে বসে এবং সেখান থেকে তাদের আহার সংগ্রহ করে। খাবারের টানেই এক ফুল থেকে অন্য ফুলে ঘুরে বেড়ায় তারা। এর মাধ্যমে তারা অজান্তেই পরাগ সংযোগ ঘটায়।

কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় বাধার প্রাচীর গড়ে তুলছে রাতের কৃত্রিম আলো। তাছাড়া, কৃত্রিম আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অনেক সময় এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছে যে, নিশাচর সব কীটপতঙ্গ রাতে আস্তানা ছেড়ে বেরোতেই ভয় পাচ্ছে। তারা উদ্ভিদের ফুলে গিয়ে বসতে পারছে না। তার জেরেই এ ধরনের উদ্ভিদের বংশবিস্তার থমকে যাচ্ছে। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের প্রভাবে উদ্ভিদের পত্ররন্ধ্রও সারারাত খোলা থাকছে। ফলে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় রস বাষ্প আকারে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাতে জলের অভাব ঘটছে উদ্ভিদের দেহে। আর সেই কারণেও শহরে গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, গাছের মেটাবলিজম চূড়ান্ত ভেবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে ফটো পিরিয়ডিজম বা আলোক পর্যায়বৃত্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেখানে একটি উদ্ভিদের লাইট পিরিয়ড এবং ডার্ক পিরিয়ড দুটোর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট অনুপাত থাকে, যা উদ্ভিদের ফুল ফোটানো নিয়ন্ত্রণ করে। কুঁড়ি উৎপাদনেও সাহায্য করে। কিন্তু রাতভর আলো জ্বলে থাকায় সেই ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটছে। জীবজন্তু এবং জলজ প্রাণীর জীবনেও গভীর বিপদ ডেকে আনছে এই কৃত্রিম রাতের আলো।

এ বিষয়ে জার্মান রিসার্চ সেন্টার ফর জিওসায়েন্সের ক্রিস্টোফার কিইবা বলেন, মানুষ পরিবেশে যত পরিবর্তন ঘটিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান পরিবর্তনটা এসেছে এই কৃত্রিম আলোর উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে।

তিনি মনে করেন, ক্রমবর্ধমান এই আলোক দূষণের ফলে বিপর্যস্ত হচ্ছে আমাদের পরিবেশ প্রকৃতি। তবে আলো আমাদের কোথায় দরকার আর কোথায় না সেটা বিবেচনা করতে শিখলেই আলোক দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১