বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২২ April ২০১৮

ই-কমার্সে আস্থা সঙ্কট


দেশে স্মার্টফোনের ব্যবহারের পাশাপাশি বেড়ে চলছে ডিজিটাইজেশন, যা মানুষের সময় বাঁচিয়ে জীবন করেছে আরো সহজময়। যার প্রতিফলন হচ্ছে ইলেকট্রনিক বাণিজ্য বা ই-কমার্স, সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন ধারা এফ-কমার্স। ফেসবুক ব্যবহার করেই নানা ধরনের পণ্য বিকিকিনিকেই এফ-কমার্স বলছেন ব্যবসায়ী ও খাত-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে দেশের বাজারেও ধীরে ধীরে বাড়ছে ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের পরিধি। প্রতিবছরই প্রায় ৫০ শতাংশ হারে বাড়ছে ই-কমার্সের বাজার। তবে পণ্যের গুণগত মান ও বিক্রয়-পরবর্তী সেবা নিয়ে ডিজিটাল এই ব্যবসার ওপর আস্থা হারাচ্ছে গ্রাহকরা। এতে করে ভবিষ্যতে ক্ষতির দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে বাণিজ্যিক উদীয়মান এই খাতটি।

ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে আমিকিনি ডটকম নামের একটি ই-কমার্স সাইট থেকে ব্লু-টুথ স্পিকার কেনেন ইফতেখার আজমি চৌধুরী নামে এক তরুণ। বাংলাদেশের খবরকে তিনি জানান, অর্ডার করার পর স্পিকার ঠিকই এলো, তবে ছবিতে যা দেখেছিলাম তার সঙ্গে কোনো মিল নেই। বিষয়টি আমিকিনি কর্তৃপক্ষকে জানালাম। আর তারা শুধু দুঃখিত বলেই মামলা খালাস করে দেয়।

এদিকে নতুন গ্রাইন্ডার (মসলা ভাঙার মেশিন) অর্ডার করে ব্যবহূত এবং ভাঙা পণ্য পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন কামরুন নাহার নামে আরেক ভোক্তা। বাংলাদেশের খবরকে তিনি জানান, কিকসা ডটকম নামের ই-কমার্স সাইট থেকে তিনি নিমা ব্র্যান্ডের একটি গ্রাইন্ডার অর্ডার করেন। ক্যাশ অন ডেলিভারিতে কেনা পণ্যটি বুঝে পেয়ে যখন তিনি প্যাকেটটি খুলেন, ততক্ষণে তার মাথায় হাত। কারণ গ্রাইন্ডারটি ছিল ভাঙা এবং ব্যবহূত। এরপর কিকসা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালে তারা পরিবর্তন করে দেওয়ার কথা বলে। একই সঙ্গে তারা এও বলে, যে গ্রাইন্ডারটি তাকে কুরিয়ার করতে হবে, কুরিয়ারের টাকাও গ্রাহককেই দিতে হবে।

কামরুন নাহার বলেন, তাদের শর্ত মেনে নিয়ে আমি গ্রাইন্ডারটি কুরিয়ার করি। পরে এক সপ্তাহ পর তারা আবার একটি গ্রাইন্ডার পাঠায়, তবে এটিও ভাঙা। পরে আমার মা তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ক্ষেপে যান, একপর্যায়ে ফোনে তাদের সঙ্গে চেঁচামেচিও করেন এবং তাদের ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি তুলে ধরেন। এরপরও কিকসা থেকে কেউ আর যোগাযোগ করেনি। উল্টো ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার এবং মোবাইল দুই জায়গা থেকেই আমাকে ব্লক করে রাখা হয়।

একই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় একই অভিযোগ করেন বেসরকারি চাকরিজীবী আবু হানিফ শেখ। তিনি বলেন, কিকসা ডটকম থেকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ১২ হাজার এমএএইচ রিম্যাক্স প্রোডা ব্যান্ডের একটি পাওয়ার ব্যাংক কিনি। প্রথমেই তাদের ডেলিভারি দেওয়া নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেওয়ার কথা থাকলেও তারা এক সপ্তাহ পর পণ্যটি ডেলিভারি দেয়। পণ্যটি হাতে পাওয়ার পর আমি লক্ষ করি পাওয়ার ব্যাংকটিতে ১২ হাজার এমএএইচ উল্লেখ থাকলেও সর্বোচ্চ ৪ হাজার এমএএইচ ক্ষমতার মোবাইলের ব্যাটারিকে মাত্র একবার চার্জ করা যেত। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি নিয়ে কিকসা ডটকমকে অভিযোগ করলে তারা রিটার্ন পলিসি অনুযায়ী অন্য একটি পাওয়ার ব্যাংক বদল করে দেয়। কিন্তু পাল্টে দেওয়া পাওয়ার ব্যাংকটিতেও একই সমস্যা ছিল। আবারো বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাতে তাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করি। তবে এবার আর তা সম্ভব হয়নি। কিকসার ফেসবুক পেজের ম্যাসেজ বক্সে বার বার ম্যাসেজ করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে কারো উত্তর পাইনি। এমনকি তাদের হটলাইনে কল করলেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাদের কোনো কাস্টমার ম্যানেজার এ বিষয়ে কোনো সমাধান করেনি।

শুধু ই-কমার্স নয়। অভিযোগ আছে ফেসবুককেন্দ্রিক অনলাইন পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ওপরও। সামিয়া তাবাসসুম নামে এক নারী ক্রেতা শাড়ি কিনেছিলেন ইভস নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে। সামিয়া জানান, প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজ থেকে একটি শাড়ি পছন্দ করে কিনেছিলাম ১০৫০ টাকা দিয়ে। তবে আমি যেই শাড়িটি দেখেছিলাম, তা উজ্জ্বল বর্ণের ছিল। তবে আমার কাছে যেই শাড়িটি পাঠানো হয়েছে তা একদমই ম্যাড়মেড়ে রঙয়ের ছিল। আমি দেখেই ডেলিভারি দিতে আসা ব্যক্তিকে বললাম। আমি এই শাড়িটি ফিরিয়ে দিতে চাই। কিন্তু ফেরত নিতে নারাজ ওই ব্যক্তি জানান- তার কাজ শুধু পৌঁছে দেওয়া, ফেরত নেওয়া নয়।

সামিয়া আরো বলেন, আমি যেহেতু ঢাকার বাইরে যাই, তাই তৎক্ষণাৎ আর ওই পেজ মালিককে জানানো হয়নি। তবে ফেরার পর কিছুদিন আগে তাকে আমি বিষয়টি জানাই। তখন ওই পেজের মালিক আমাকে বলেন, আমি শুধু শুধু তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছি। ওই ছবিটা যেহেতু কালার কারেকশন করা ছিল তাই দেখতে অমন ছিল।

একই অভিযোগ করেন আরেক তরুণী দিলরুবা হোসেন। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, সেভিংস ডটকম নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে আমি একটি লেহেঙ্গা অর্ডার করেছিলাম। পরে আমার ইনবক্সে তাদের সঙ্গে কথা হয় এবং তারা আমাকে ইনবক্সে আরো কিছু ছবি দেখায়, যা দেখে মান নিশ্চিত করে, আমি লেহেঙ্গা অর্ডার করলাম। তবে আমি যেই লেহেঙ্গাটি হাতে পেয়েছি, তার সঙ্গে ছবির লেহেঙ্গার কোনো মিলই নেই। না রঙের সঙ্গে, না কাপড়ের মানের সঙ্গে।

তিনি বলেন, এ ঘটনার পর থেকে আমি আর কখনো অনলাইন সাইট বা ফেসবুক পেজ থেকে পণ্য কিনব কি না তা সন্দেহ আছে। তবে আমি ই-কমার্সের প্রতি একেবারেই বিরক্ত হয়ে পড়েছি। কারণ এর আগেও এ রকম অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি।

অভিযোগ নিয়ে কিকসা ডটকমের প্রধান নির্বাহী জিসান কিংশুক বাংলাদেশের খবরের কাছে দুটি অভিযোগই অস্বীকার করে বলেন, আমাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ আসেনি। যেই গ্রাহক বলেছেন তাকে ব্লক করে রাখা হয়েছে, তার উত্তরে আমি বলব- আমাদের এমন কোনো পলিসি নেই, যেখানে গ্রাহককে ফোন কিংবা ম্যাসেঞ্জার থেকে ব্লক করা হবে।

তিনি আরো বলেন, যেহেতু দুজন গ্রাহকই বলেছেন তাদেরকে আমরা একবার পণ্য রিপ্লেস করেছি, তাহলে বুঝতেই পারছেন আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রাহককে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছি। আমরা তিন হাজার পাওয়ার ব্যাংক বিক্রি করেছি। সেখান থেকে দু-একটা খারাপ পণ্য বের হতেই পারে। তাই খারাপ পণ্য ফেরত নিয়ে বদলেও দিয়েছি। আর এতেও যদি গ্রাহক সন্তুষ্ট না হয় তাহলে তাদেরকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবেন, প্রয়োজনে তাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।

একই বিষয়গুলো নিয়ে বাগডুম ডটকমের সিইও মিরাজুল হকের সঙ্গে আলোচনা করা হলে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা কোনো মার্চেন্ট নিয়োগ দেওয়ার আগেই তার পণ্যের দাম, গুণগত মান এবং ডেলিভারি সময়সীমা দেখি। আমাদের নিজস্ব মান নিয়ন্ত্রণ দল এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করে। গ্রাহক ভোগান্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ, একজন মার্চেন্টের খারাপ সেবার কারণে আমরা কোনোভাবেই একজন গ্রাহককে হারাতে চাই না।

তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত, যেমন আমাদের লজিস্টিক পার্টনার, আমরা ই-কমার্স ব্যবসায়ী এবং আমাদের মার্চেন্ট পার্টনার। আমরা সবাই যদি আমাদের নিজ নিজ কর্মপ্রক্রিয়ার মান ঠিক রাখি তাহলেই গ্রাহকের চাহিদা পরিপূর্ণ করা সম্ভব।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের এই প্রধান নির্বাহী বলেন, ওয়েবসাইটে দেওয়া পণ্যের গায়ে বা সঙ্গে যা লেখা আছে, গ্রাহকের কাছে সেই উপাদানই যাওয়া উচিত। আর এই পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের। না হয় এই খাত থেকে গ্রাহক সংখ্যা বাড়ার বদলে তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।

ই-কমার্সের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে করণীয় হিসেবে মিরাজুল ইসলাম বলেন, পণ্যের গুণগত মান ও সঠিক সময়ে গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দেওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে রিটার্ন পলিসি আরো সহজতর করতে হবে। যাতে করে গ্রাহক তার পছন্দকেই গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনভাবে পণ্য ক্রয় করতে পারে।

এ বিষয়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ই-কমার্স খাতের প্রাণ হচ্ছেন গ্রাহক। গ্রাহক ছাড়া ই-কমার্স কেন, কোনো বাণিজ্যই টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে গ্রাহক স্বার্থকে আমরা সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছি।

এই সংগঠক বলেন, যদি কোনো গ্রাহক আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন আমরা সেই অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। একই সঙ্গে গ্রাহকের সঙ্গেও যোগাযোগ করে বিষয়টি সমঝোতার চেষ্টা করি।

তিনি আরো বলেন, যেহেতু এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের গ্রাহক স্বার্থ দেখতেই হবে, তাই একই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ এলে আমরা ওই প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বাতিল করে দিতে পারি। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বাতিল হয়নি বলে জানান আবদুল ওয়াহেদ তমাল।

বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমাদের ই-কমার্স ব্যবসা শুরু হয়েছে অনেক পরে। প্রথম দিকে এই সাইটগুলো থেকে বেচাকেনা ভালো হলেও বর্তমানে গ্রাহকরা এখান থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে এই খাত থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবেন গ্রাহকরা। একই সঙ্গে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এই খাতের ভরাডুবি ঘটবে। এসব অভিযোগ শুনে এমনটাই মন্তব্য করেছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এখনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকাতেই গ্রাহকদের এমন সব সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিছু কিছু ই-কমার্স ব্যবসায়ী প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম করে সম্ভাবনাময় এই খাতকে নষ্ট করে তুলছেন। আর এতে ই-কমার্সের ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন গ্রাহকরা। গ্রাহকদের আস্থা সঙ্কটে পড়লে এই খাত অস্তিত্ব হারাতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তারা।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১