আপডেট : ২০ April ২০১৮
একটি প্রশ্ন আজ অনেকেই করে থাকেন, আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি? মূল্যবোধের যে অবক্ষয়ের ধারা সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাবে- এ ভেবে শঙ্কিত অনেকেই। এ শঙ্কার কথাই জানালেন গুণী কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী। দেশের একজন জনপ্রিয় শিল্পীও তিনি। তার রয়েছে একটি গৌরবময় উত্তরাধিকার। স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী মরহুম মাহমুদুন্নবীর মেয়ে তিনি। সাংস্কৃতিক জগতে তার বিচরণ অবিরত। তার চিন্তা-ভাবনায় সাংস্কৃতিক বিষয়াদি প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কিন্তু তিনিও এখন সমাজ নিয়ে ভাবছেন। এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। উঁচুস্তরের একজন মানুষ তার বিচরণ ক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে দেশ, জাতি আর মানুষকে নিয়ে ভাববেন অবশ্যই। সামিনা চৌধুরী দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আর তার এ শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে। গত ৩ এপ্রিল প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সবাই কেমন ছুটছে। গন্তব্যহীন। অস্থির। কারো কোনো স্টেশন নেই। কেমন যেন অধরা সোনার হরিণের পেছনে সবাই দৌড়াচ্ছে। এই অস্থিরতাই আমাদের সমাজের সর্বত্র।’ সামিনা তার সাক্ষাৎকারে এ অস্থিরতা থামাতে হবে মন্তব্য করে বলেছেন, দেখে-শুনে-বুঝে দৌড়ানো উচিত। তা না হলে আমাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। শিল্পী সামিনা চৌধুরীর কথাগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের চারপাশে একটু গভীরভাবে তাকালেই এ অস্থিরতার বিষয়টি সহজেই ধরা পড়বে। সবাই নিজেকে নিয়ে এমন ব্যস্ত, সামনের দিকে এমনভাবে দৌড়াচ্ছে, যেন সময় ফুরিয়ে গেল, আর পাওয়া যাবে না। সবাই সুখ নামে শুকপাখিটাকে হস্তগত করার জন্য যেন দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি যেকোনো মূল্যে যেন পেতেই হবে। সেখানে নীতি-নৈতিকতা গৌণ। আর কাম্য বস্তু পাওয়ার উদগ্রতার কারণে সমাজে ঘটছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম আজ আমাদের দেশে অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। তাও কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুখকে করায়ত্ত করার এক ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত মানসিকতা থেকেই। নীতিহীনতা আমাদের সমাজের একটি অংশকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে, কেউ নীতি-নৈতিকতা নিয়ে চলতে গেলে উপহাসের পাত্র হতে হয়। যদি বলা হয়, ওই রাজনীতিক বা আমলা সৎ, কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। যদি বলা হয়, উনি ঘুষ খান না, প্রশ্ন শুনতে হয়- কত টাকা পর্যন্ত খান না। নেতিবাচক ধারণা আমাদের মনে এমনভাবে শিকড় প্রোথিত করেছে যে, ইতিবাচক কোনো চিন্তাই যেন আমরা করতে পারি না। আমাদের দেশের চলমান সামাজিক পরিস্থিতিকে কি স্বাভাবিক বলা যায়? এ প্রশ্নের জবাব একেকজন একেকভাবে দেবেন, এটা ঠিক। তবে, যে সমাজে হত্যা, গুম, ধর্ষণ নিত্য যে দেশে ঘুষ ছাড়া চাকরি পাওয়া যায় না, টেন্ডার পাওয়া যায় না, অফিসের ফাইলের গতি স্লথ হয়ে যায়, সে দেশের মানুষ কীভাবে বলবে আমরা স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে বাস করছি? কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? আসলে আমরা ছুটছি কিসের আশায়, কোথায় গিয়ে থামব তা যেন কারোই জানা নেই। শুধু জানি সুখ নামে সোনার বরণ পাখিটাকে খাঁচাবন্দি করতে হবে। অনেকেই সুখ খুঁজছেন অনৈতিক পথে অর্থ-বিত্তের পাহাড় গড়ে। এ পথে যদি কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাকে চিরতরে সরিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না অনেকেই। তাদের চোখে পরা আছে স্বার্থের ঠুলি। ফলে স্বার্থ হাসিলের জন্য জঘন্যতম কাজ করতেও বাধে না। স্বাধীনতার আগে কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার গেয়েছিলেন- ‘স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে সরে চলে যায়...’। আজ তার বাস্তব প্রতিফলন দেখছি আমরা। সম্পত্তির লোভে সন্তান কর্তৃক বাবা-মা হত্যা, ভাই ভাইকে, বোন ভাইকে হত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ। লোভের কাছে পরাস্ত সব নীতি-নৈতিকতা। নিজের প্রয়োজনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সে প্রয়োজন মেটাতে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে কতিপয় মানুষ তিলমাত্র দ্বিধা করে না। সমাজটাকে অনেকে বসবাসের অযোগ্য মনে করেন। তাদের কথা হলো- যে সমাজে চার বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়, সে সমাজ বাসযোগ্য কীভাবে বলা যায়? প্রতিনিয়ত ঘটছে নারীর সম্ভ্রমহানির ঘটনা। কোনো ঘটনায় ধরাও পড়ছে মানবরূপী সে জন্তুগুলো। কিন্তু তারপরও থামছে না এ পাশবিকতা। সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াকে দায়ী করেন। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আরেকটি অপরাধ সংঘটনের পথ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে বলেও তারা অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। এ যুক্তি খণ্ডন করার অবকাশ নেই। কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলল। কিন্তু কে বা কারা এ অপরাধটি করল আজতক তা জানা গেল না। তাহলে কী তনুকে কেউ হত্যা করেনি? দেশের চৌকষ গোয়েন্দারা সেই না জানা দুর্বৃত্ত বা দুর্বৃত্ত দলের কোনো খোঁজই পেল না! প্রতিনিয়ত ঘটে চলা হাজারো ঘটনার নিচে একদিন হয়তো এ বর্বরতম ঘটনাটি চাপা পড়ে যাবে। এমন হাজারো ঘটনা ঘটছে আমাদের সমাজে। সব প্রচার প্রকাশ পায় না। কোথাও প্রতাপশালীদের প্রভাবে, কোথাও অবৈধ অর্থের দাপটে সেসব ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতার কথা বলতে গিয়ে বোধকরি একটু প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলাম। আবার মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। আমরা প্রতিনিয়ত দৌড়াচ্ছি। শুধুই সামনের দিকে। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ানোর ফলে আমরা পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অনেক সময়ই থাকছি উদাসীন। ফলে হোঁচট খাচ্ছি, মুখ থুবড়ে পড়ছি, আবার কখনো নিপতিত হচ্ছি গভীর খাদে। এ সবই আমরা করছি এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে। কে কার আগে যাওয়ার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, তা থেকে জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য মর্মান্তিক ঘটনা। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা দুই দিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় জন্ম দিয়েছে দুটি মর্মন্তুদ ঘটনা। যা সচেতন মানুষদের যুগপৎ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। প্রথম ঘটনাটি ৩ এপ্রিলের। দুই বাসচালকের কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রতিযোগিতায় ডানহাত হারাতে হয়েছে কলেজছাত্র রাজীব হোসেনকে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে রাজীব শেষ পর্যন্ত হেরে গেছে। তিনি আর বেঁচে নেই। সে ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে ইতোমধ্যে সবাই অবগত হয়েছেন। কারওয়ানবাজারের সার্ক ফোয়ারার সামনে থেমে থাকা বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাসকে বাম দিক দিয়ে ওভারটেক করতে গিয়ে সজোরে ঘষা লাগায় স্বজন পরিবহনের একটি বাস। বিআরটিসি বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজীবের ডান হাত দুই বাসের চিপায় পড়ে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই বাসচালকের আগে যাওয়ার উন্মাদনার শিকার হয়ে রাজীবের সব স্বপ্ন আজ ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। রাজীব এখন কবর দেশে। রাজীবের মতো আরেক হতভাগিনী আয়েশা খাতুন। ৫ এপ্রিল সে-ও দুই বাসচালকের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে আজ চলৎশক্তি হারানোর পথে। খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার নিউমার্কেট এলাকা দিয়ে তিনি রিকশায় যাচ্ছিলেন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসতে। তাদের রিকশার ডান পাশে চলছিল বিকাশ পরিবহনের একটি বাস। হঠাৎ ওই একই পরিবহন কোম্পানির আরেকটি বাস দ্রুতগতিতে বাঁ পাশ দিয়ে এসে আয়েশা খাতুনের রিকশাকে চাপা দেয়। মারাত্মক আহত হন তিনি। আহত হয় মেয়ে আহনাদও। চিকিৎসকরা বলেছেন, আয়েশা খাতুনের আঘাত অত্যন্ত মারাত্মক। আঘাতে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে। তিনিও আর কোনোদিন স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবেন না। চোখ মেলে তাকালে এ ধরনের প্রতিযোগিতা সমাজের সর্বত্র দেখা যাবে। স্বার্থের সন্ধানে ছুটছে সবাই। কারো দিকে তাকানোর সময় যেন নেই! আমরা যেন একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় আছি। আগে যাওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছি। কখনো কখনো সামনেরজনকে ফেলে দিচ্ছি ল্যাং দিয়ে। এ অনৈতিক কাজ করতে আমরা দ্বিধা করছি না! স্বার্থের কাছে বিবেক বিবেচনা এখন অতি তুচ্ছ বিষয়। প্রতিযোগিতা দোষের নয়। বরং সুস্থ প্রতিযোগিতা একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে পালন করতে পারে অন্যতম নিয়ামকের ভূমিকা। ক্রীড়াক্ষেত্রে একটি স্লোগান আছে- ‘বিজয় মহান, বিজয়ের সংগ্রাম মহত্তর।’ মানুষ বিজয় অর্জন করতে, সাফল্য লাভ করতে, নিজের কাঙ্ক্ষিত বস্তুকে অর্জন করতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সে প্রতিযোগিতা হতে হবে সুস্থ। সামনেরজনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে, তবে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে বা কনুইয়ের গুঁতোয় ধরাশায়ী করে নয়। এগোতে হবে নিজের শক্তি আর বুদ্ধিকে সৎভাবে ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের সমাজে আজ সে সুস্থ প্রতিযোগিতা যেন অনুপস্থিত। সোজা পথে না গিয়ে সবাই কেন যেন বাঁকা পথে যেতে বেশি আগ্রহী। আর এ বাঁকা পথে চলতে গিয়েই আমরা জন্ম দিচ্ছি নানা দুঃখজনক ঘটনার, কারো কারো জীবনে নেমে আসছে অভিশাপ। আমাদের এ সমাজকে পরিচ্ছন্ন করতে হলে, মানুষের বাসযোগ্য রাখতে হলে, সর্বোপরি আমাদের জীবনকে নিরাপদ করতে হলে সবাইকে বুঝে-শুনে দৌড়াতে হবে। অন্যথায় আমরাই পড়ব মহাবিপর্যয়ের করাল গ্রাসে। মহিউদ্দিন খান মোহন সাংবাদিক ও সমাজবিশ্লেষক mohon91@yahoo.com
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১