বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৮ April ২০১৮

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ৫ বছর

এখনো সমস্যায় শ্রমিকরা, সংস্কার উদ্যোগেও অগ্রগতি কম

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের গবেষণা


রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৪৮ শতাংশ কাজ করতে পারছেন না। শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তাদের এ অবস্থা। আবার ওই দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও পোশাক খাতের উন্নয়নে সরকার, মালিক ও ক্রেতারা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষ করে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়ন করা, মজুরি ও ভবন নির্মাণ বিষয়ে যথাযথ আইন ও উদ্যোগের অভাবে এখনো পোশাক খাতের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের একটি গবেষণা বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার ঢাকায় ব্র্যাক সেন্টার ইনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গবেষণা ও বিশ্লেষণপত্র তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে সরকার, মালিক, বিদেশি ক্রেতা, শ্রমিক সংগঠন এবং রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকসহ সব পক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর প্রতিবছরের মতো এবারো পরিস্থিতি তুলে ধরতে দুর্ঘটনার শিকার জীবিত ২০০ শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে একটি গবেষণা করে অ্যাকশনএইড। গবেষণায় দেখা যায়, জীবিত শ্রমিকদের মধ্যে ১২ শতাংশের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর ২২ শতাংশ শ্রমিক এখনো মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রমিক এখনো কোনো কাজ করতে পারছেন না। অন্যদিকে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক পোশাক কারখানায় আবারো যুক্ত হতে পেরেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার নুজহাত জেবিন।

শ্রমিকদের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরার পাশাপাশি রানা প্লাজা দুর্ঘটনাপরবর্তী পোশাক খাতের উন্নয়নে যেসব সংস্কার ও নীতিগত উদ্যোগ সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষ নিয়েছিল তারও পর্যালোচনা করা হয়। ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের শিল্প খাত : উদ্যোগ ও পরিবর্তন’ নামক বিশ্লেষণটি উপস্থাপন করেন ডেভেলপমেন্ট সিনার্জি ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জাকির হোসেন।

তিনি বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা নানাভাবে সহযোগিতা পেয়েছেন। তবে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে কোনো মানদণ্ড ঠিক করা হয়নি। নেই আইনি কাঠামোও। আবার দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার এবং বিদেশি ক্রেতারা। তবে তাদের কাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভবনের উন্নয়ন অর্থাৎ কারিগরি সংস্কার। শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকরা প্রথম দিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দ্রুত কিছু টাকা পেয়েছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। এ ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমরা ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম। তবে আইনে মাত্র ১ লাখ টাকা দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর আইনের দোহাই দিয়ে মালিকরা ক্ষতিপূরণ দিতে চান না।’

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, ‘সাভারের দুর্ঘটনার পরও আমাদের টনক নড়েনি। এখনো ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিধিমালা মানা হচ্ছে না। যে যার মতো করে ভবন তৈরি করছেন। আবার সাভার দুর্ঘটনার পর অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এখনো তা ভাঙা হচ্ছে না। কারখানার যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কি না তা দেখারও কেউ নেই। নেই জবাবদিহিতা।’

ভবনের ঝুঁকিপূর্ণতা নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, ‘সঠিকভাবে ভবন নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড তৈরি করা হয়েছিল সেই নব্বই দশকে। তবে সেটি এখনো আইনে রূপান্তরিত হয়নি। ফলে মানুষ বিধিমালা মানে না। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নেওয়া হয় না। সাভারের ঘটনা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। অনুমোদন ছাড়াই পাঁচতলা ভবন নয়তলা হয়ে গেল। পৌরসভা যাচাই-বাছাই না করেই অনুমোদন দিয়ে দিল। এ রকম পরিস্থিতি অনেক জায়গাতেই।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সম্প্রতি আশুলিয়ায় শ্রমিকরা যখন তাদের অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করলেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হলো। তারা নিজের কথাগুলো বলতে পারেন না। ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না শ্রমিকরা।’

অনুষ্ঠানে কথা হয় শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো নিয়েও। এ বিষয়ে অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘বাংলাদেশের শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরিও পান না। আমাদের মাথাপিছু জাতীয় মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার ওপর। যেখানে শ্রমিকরা পান ৫ হাজার ৩০০ টাকা। এটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন হওয়া উচিত ২২ হাজার টাকা। বেতন বাড়লে শিল্প টিকবে না, মালিকদের এমন দাবি ও ধারণা একেবারেই ভুল। কারণ আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে।’

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি ড. ওয়াজেদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান করতে হলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা জোরদার করতেই হবে। শ্রমিকদের ইউনিয়ন কার্যত নেই। যাও আছে শুধু লোক দেখানোর জন্য।’

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যে সংস্কার ও উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষ করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। শ্রমিকরা যাতে সম্মানজনক এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরি পান, এজন্য সরকার, মালিক ও ক্রেতাদের দায়িত্ব নিতে হবেই। শ্রমিক অধিকারবিষয়ক যেসব আইন আছে তা প্রয়োগের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। আর যদি পরিস্থিতির পরিবর্তন না হয় তাহলে আমরা দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারব না। দূর হবে না অসমতা এবং বৈষম্য।’

বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছবি বিশ্বাস বলেন, ‘নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ পাওয়া, ভালো মজুরি পাওয়া শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি। মানবিক কারণে হলেও শ্রমিকদের দিকে তাকানো দরকার।’


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১