বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৯ September ২০২৪

শিল্প মালিকদের করালগ্রাসে অস্তিত্ব হারিয়ে মৃতপ্রায় লবলং নদী


শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি:

সবুজে-শিল্পে ভরপুর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এখানকার খাল ও জলাধারগুলো। কিন্তু শিল্প মালিকদের করালগ্রাসে অস্তিত্ব হারিয়ে এখন মৃতপ্রায় লবলং নদী। বিভিন্ন কম্পানির তরল বর্জ্যে শ্রীপুরের খালগুলো দূষিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে । খালগুলো দখল ও দূষণে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

স্থানীয়রা বলেন যেসব শিল্প-কারখানা খালগুলো দখল-দূষণযজ্ঞে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে জলাধার রক্ষা আইন ও পরিবেশ রক্ষা আইনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। নদ-নদী-খাল দখল ও দূষণকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের আপসহীন ভূমিকা অব্যাহত থাকা উচিত।বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।আর ঢাকার খুব কাছে সবুজের সমারোহে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা। যদিও বর্তমানে শ্রীপুর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য নয়, শিল্পনগরী হিসেবে বেশি পরিচিত।

শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে ওঠায় এ এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে, উন্নত হয়েছে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান। আর এর বিনিময়ে স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি এ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে দিতে হচ্ছে চরম মূল্য। একদিকে নদী, খাল, বিল আর ফসলি জমি ভরাট করে তৈরি হচ্ছে কলকারখানা, অন্যদিকে এসব কারখানার তরল ও কঠিন বর্জ্য দুর্বিষহ করে তুলছে এ এলাকার পরিবেশ। এর ফলে এ এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খাল, বিল, পুকুর, নালার মতো জলাশয়গুলো। একসময় সারা দেশে ব্যাপক পরিচিত শ্রীপুরের লবলং সাগর এখন বিলীন হওয়ার পথে! একসময়ের লবলং সাগর, যা এখনকার লবলং খাল।

খালটির উৎপত্তি হয়েছে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ সীমান্তঘেঁষা ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার ক্ষীরু নদীর সংযোগস্থল থেকে। এরপর আঁকাবাঁকা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে মীর্জাপুরের কাছে তুরাগ নদে মিশেছে। জনশ্রুতি আছে, একসময় এ লবলং সাগর দিয়ে চলত পালতোলা নৌকা, শোনা যেত মাঝির আকুল করা গান।জানা যায়, ১৯৬৫ সালের দিকেও এর জৌলুস ছিল নদীর মতো। ক্রমেই এটি তার প্রাণ হারাতে থাকলে ১৯৯৩ সালে সরকার এই খাল পুনঃখননের উদ্যোগ নেয়। সে সময় লবলংয়ের নাব্যতা কিছুটা ফিরে আসে; কিন্তু পরবর্তী সময়ে লবলংয়ের আশপাশে দখল-দূষণের আগ্রাসন বাড়লেও আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেই নদ এখন চরম অস্তিত্বসংকটে, দখল-দূষণ আর অনিয়ন্ত্রিত অত্যাচার-অবহেলায় হারিয়ে ফেলেছে তার গতিধারা। লবলং খাল দখল করে খালের পাড় ভরাট করে নদের ওপর কিংবা এর গতিপথ পরিবর্তন করে গড়ে উঠেছে শত শত কলকারখানা।

শিল্প মালিকদের জবর দখলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে লবলং নদী। এক সময়ের প্রবহমান নদী এখন খাল। তাও এখন পরিণত হচ্ছে ড্রেনে। প্রভাবশালী শিল্প মালিকদের করালগ্রাসে অস্তিত্ব হারাচ্ছে লবলং নদী। অন্যদিকে উপজেলার প্রায় সব খালই লবলংয়ের সঙ্গে যুক্ত। ফলে পরিস্থিতি হয়েছে আরো ভয়াবহ, লবলংসহ আশপাশের সব খালই পৌঁছেছে দখল-দূষণের চরম মাত্রায়।লবলং খালের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করে দেখা যায়, এর পুরো অংশই গিলে ফেলেছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। শুধু কলকারখানা নয়, স্থানীয় জনগণ, এমনকি বিভিন্ন সরকারি সংস্থাও খালটির অস্তিত্ব সম্পর্কে চরম উদাসীন।

সরেজমিনে চকপাড়া-আদুরবান ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে অন্য রকম চিত্র। ব্রিজের পূর্ব-পশ্চিম পাশ লোহার খাঁচা দিয়ে আবৃত। পশ্চিম পাশে খালের এক পাড়ে সলভো কেমিক্যাল আর অন্য পাড়ে নির্মাণাধীন গ্রেটওয়াল সিরামিকস। দুটি কারখানাই খালের পাড় দিয়ে জেলখানার মতো করে দেয়াল টেনেছে। পূর্ব পাশে চলছে রিদিশা গ্রুপের তাণ্ডব। ফসলি জমি, খাল কিছুই রেহাই পাচ্ছে না তাদের হাত থেকে। দখল, ভরাট আর দূষণ সমানে চলছে। তা ছাড়া মাওনা উত্তর পাড়া এলাকায় অবস্থিত ডেকু গার্মেন্টস কারখানার কতৃপক্ষ আদুরবান ব্রিজ থেকে দক্ষিণ দিকে খালের তীর ঘেঁষে এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বালু দিয়ে ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করছেন। তা ছাড়া মাওনা উত্তর পাড়ায় নোমান গ্রুপ ও নয়নপুরে মেঘনা-ডিবিএল গ্রুপ খালের প্রবাহ স্থবির করে দিয়েছে।

মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কের মাওনা পাথারপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পূর্ব পাশে গ্রামীণ টেলিকমের দখলযজ্ঞ। পশ্চিম পাশে রয়েছে ক্রাউন উলেন ওয়্যার। তাছাড়াও লবলংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ খাল মাস্টারবাড়ি খালে অবাধে ফেলা হচ্ছে পৌরসভার বর্জ্য। এ ছাড়া দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে খালের তলদেশ থেকে বড় বড় বুদ্বুদ বের হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশপাশের কারখানার দূষিত পানি নিষ্কাশনের লাইন খালের তলদেশ দিয়ে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। গরগরিয়া মাস্টারবাড়ি এলাকায় আরো দেখা যায়, মহাসড়কের পূর্ব পাশে খালটির প্রবাহ স্থবির করে দিয়েছে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও হাউ আর ইউ কম্পানি। এ ছাড়া লবলংয়ের অন্যান্য পয়েন্টের মধ্যে বারতোপা ও বেড়াইদের চালা সীমান্ত নির্ধারণকারী এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এক্স সিরামিকসের আগ্রাসন। এ এলাকায় লবলং খালটিকে তিন দিক থেকেই চেপে ধরেছে এক্স সিরামিকস কারখানাটি।

একবার বালুর বস্তা দিয়ে আবার কালভার্ট বানিয়ে খালের এপাশ-ওপাশ যুক্ত করা হয়েছে। আবার খালের গতিপথও পরিবর্তন করা হয়েছে। কঠিন বর্জ্র, তরল বর্জ্য—সবই ফেলা হচ্ছে এই খালে। ফসলি জমি ভরাট করার অভিযোগও রয়েছে কারখানাটির বিরুদ্ধে। দিনে দিনে এলাকার ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এলাকার অসহায় মানুষ একে নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছে। এর দক্ষিণ পাশে খালসংলগ্ন ভিনটেজ ডেনিম নামে আরেকটি কারখানা রয়েছে। শ্রীপুরের বৈরাগীর চালায় গিয়ে দেখা মেলে চক্কার খালের। এই খালও মাস্টারবাড়ি খালের মধ্য দিয়ে লবলংয়ে মিশেছে। বৈরাগীর চালার এ খালের উত্তর পাশে হ্যামস গার্মেন্টস আর দক্ষিণ পাশে হ্যামস ওয়াশিং প্লান্ট। দখল-দূষণে মৃতপ্রায় খালটি এখন বিষের নালায় পরিণত হয়েছে।

অদূরে থাকা সফ্টটেক্স ও ইউনিলাইনসের বিষের লাইনটিও চক্কার খালে সংযুক্ত।শ্রীপুরের বৈরাগীর চালায় কেউয়া নামে রয়েছে আরো একটি খাল। দখল-দূষণ আর আগ্রাসন চালিয়ে এ খালেরও গলা টিপে ধরেছে আমান গ্রুপ ও চট্টগ্রাম ডেনিম।শুধু উল্লিখিত কারখানাগুলোই নয়, এ অঞ্চলের প্রায় সব কারখানার ভারী পদার্থ নামের তরল বিষ এ খালগুলোর মাধ্যমেই নদীতে যায়। এতে এলাকার মানুষের পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে তুরাগ নদেরও। দূষণের ভয়াবহতা স্থানান্তরিত হচ্ছে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে।

নদী নিয়ে কর্মরত নদী পরিব্রাজক দলের শ্রীপুর উপজেলা শাখার সভাপতি ও রসায়নবিদ সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘এ তরল বর্জ্যে রয়েছে বিষাক্ত ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর লেড, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল, প্লাটিনাম, সায়ানাইড, কপার, ক্যাডমিয়াম, অ্যান্টিমনি, মার্কারি ও জিংক। যা মানবদেহ ও প্রাণ-প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। অনতিবিলম্বে শ্রীপুরের সব খালের সীমানা নির্ধারণ করে খালগুলো উদ্ধার করতে হবে এবং পুনঃখনন করতে হবে। নতুবা এ জনপদ বাঁচানো যাবে না।

’ সংবাদকর্মী আজাহারুল ইসলাম সালাম বলেন, ‘একসময় এ খালগুলো দিয়েই শ্রীপুর উপজেলার পানি নিষ্কাশন হতো। কিন্তু যেভাবে খাল দখল হয়ে যাচ্ছে, তাতে একসময় শ্রীপুরের প্রধান সমস্যা হবে জলাবদ্ধতা।শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক বলেন, ‘শ্রীপুরের খালগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করতে প্রশাসনকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে।শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও ব্যারিস্টার সজীব আহমেদ জানান, ‘খালগুলো উদ্ধারে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা খালগুলো দখল-দূষণ করে জনজীবন বিপন্ন করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১