বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১১ January ২০২১

পাঁচদোনার যুদ্ধ


ফকির আবুল কালাম আজাদ

 

 

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণার একটা বিড়ম্বনা আছে, মনে এত স্মৃতি জেগে ওঠে যে, স্বল্প পরিসরে এর শুরু-শেষ কীভাবে করব, তা স্থির করা দুরূহ হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালে আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। তখন উত্তাল সময়। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে আন্দোলন-সংগ্রামের ঢেউ। আওয়ামী লীগের ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, শেখ মুজিবের মুক্তি, গোলটেবিল বৈঠক, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা, নরসিংদীর কৃতী সন্তান শহীদ আসাদের আত্মাহুতি, আইয়ুব খানের পতন, মওলানা ভাসানীর পাকিস্তানিদের প্রতি আহ্বান ‘লা-কুম দ্বী নুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ— এসব যুগান্তকারী ঘটনা আমাদেরও প্রভাবিত করে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে বাজার, রাস্তা, রেলস্টেশন ঘুরে বেড়াতাম। এভাবেই জাতীয় ধ্যান-ধারণা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও গণমানুষের সংগ্রামী চেতনার সাথে একাত্মতা তৈরি হয়, যা আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা শোনার পরে এপ্রিল মাসের শুরুতেই আমি ও আমার সহপাঠী ইব্রাহীম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার বাসনায় আগরতলার উদ্দেশে রওনা দিই। পথিমধ্যে একরাত যাপন করেও আগরতলা যাওয়ার নিরাপদ রুট ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কোনো কন্টাক্ট পয়েন্টের হদিস করতে না পেরে বাড়ি ফিরে আসি। এপ্রিল মাসেই আবার চারজন সঙ্গী নিয়ে আগরতলার জয়নগর শরণার্থী শিবিরে যাই। সেখানে দুবেলা ফ্রি খাওয়া জোটে বটে কিন্তু চেষ্টা করেও যুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যোগ দিতে পারিনি, তাই ব্যর্থ মনোরথে আবার বাড়ি প্রত্যাবর্তন। এরপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ১৩ জন ছাত্রের সংগঠিত গ্রুপের সাথে পায়ে হেঁটে আগরতলার মেলাঘর ট্রেনিং সেন্টারে যাই। সেখানে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে দেশে ফিরি।

মেলাঘর তখন দুই নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার। মেজর খালেদ মোশাররফ সেক্টর কমান্ডার। ক্যাপ্টেন হায়দার সহকারী সেক্টর কমান্ডার ও ক্যাম্প ইনচার্জ। ক্যাপ্টেন হায়দার নরসিংদী, শিবপুর, আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ- এই চার থানা থেকে আগত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে একটি ইউনিট গঠন করলেন, যার কমান্ডার নিযুক্ত করলেন সিরাজ উদ্দিন আহমেদকে (নেভাল সিরাজ) এবং সংগঠক নিযুক্ত করলেন মীর সিরাজুল ইসলামকে (মামা সিরাজ)। আর আমাদের নরসিংদী থানার কমান্ডার নিযুক্ত করা হলো মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মাস্টার্সের এক ছাত্রকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত আমরা এই চেইন অব কমান্ড মেনে কাজ করেছি।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীর ওপর ঢাকা-নরসিংদী সড়কে পাঁচদোনা ব্রিজ। এখানে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ও সংঘর্ষ হয়েছে। পাঁচদোনা ব্রিজে দীর্ঘ সময় ধরে সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১৬ আগস্ট, সোমবার। এর তিনদিন আগে ১৩ আগস্ট শুক্রবার নেভাল সিরাজ মাত্র চারজন সঙ্গী নিয়ে ঘোড়াশাল ও নরসিংদী রেল লাইনের মধ্যবর্তী স্থানে জিনারদি রেলস্টেশনে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্প দখল করেন। চৌকশ নৌসেনা নেভাল সিরাজের সেই অপারেশন ছিল আকস্মিক, অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ও সাহসিকতাপূর্ণ। ফলে অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ, খাদ্যসামগ্রী আয়ত্তে আসে। মুক্তিযোদ্ধা পুটিয়ার ইব্রাহিম সেই অপারেশনে শহীদ হন।

এরপর ১৯৭১-এর ১৬ আগস্ট সকালে নেভাল সিরাজ থানা কমান্ডার ইমাম উদ্দিনকে পাঁচদোনা ব্রিজে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। এই অপারেশনে ব্রিজের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করার জন্য তিনটি গ্রুপ করা হলো। সেদিন এই যুদ্ধে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন থানা কমান্ডার ইমাম উদ্দিন আহমেদ, আবদুল হাকিম (ডেপুটি কমান্ডার, নরসিংদী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ), সমর লুইস ডি কস্তা, সুলতান আহমেদ, সাবেক দুই সেনাসদস্য বাদশা ও সাজাহান, মোহাম্মদ ইব্রাহিম (অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা), চাকশালের তাইজ উদ্দিন (পরে আলগী যুদ্ধে শহীদ), নলুয়ার নুরুল ইসলাম (নরসিংদী সদর থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কর্মকর্তা) এবং আমিসহ আরো অনেকে।

আমাদের অতর্কিত ত্রিমুখী আক্রমণে হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে গেল। ইব্রাহিমের ছোড়া একটি মর্টার শেল একেবারে ব্রিজের গোড়ায় পড়ে বিস্ফোরিত হলো। এদিকে আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণ। শত্রুপক্ষের হতাহতের সংখ্যা বাড়তে লাগল। আমরা ক্রমেই তিন দিক থেকে এগুতে এগুতে একেবারে ব্রিজের কাছে এসে গেছি। সেনাসদস্য সাজাহান এবং সুলতান আহমেদ সাহসের সাথে একেবার ব্রিজের গোড়া পর্যন্ত এগিয়ে সৈন্যদের উর্দুতে আত্মসমর্পণের কথা বলছিলেন। বিজয় যখন অত্যাসন্ন, তখন হঠাৎই সৈন্যভর্তি ট্রাক এলো, তাদের শক্তি বেড়ে গেল, আমাদের পিছু হটতে হলো। এ সময় সুলতানকে লক্ষ্য করে হঠাৎ ব্রাশ ফায়ার করলে তার বাহু গুলিবিদ্ধ হয়। সে দ্রুত মাটিতে পড়ে ডিগবাজি খেয়ে গর্তে আশ্রয় নিল। আমরা তাকে কাভার দিয়ে রিট্রিট করার সুযোগ দিলাম এবং সবাই যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলাম।

সুলতানকে আমরা ধরে পার করছিলাম। যখন হাঁটতে অসুবিধা, তখন এক বাড়ির গোয়ালঘর থেকে পাওয়া জমি চাষের মইয়ের ওপর শুইয়ে দিলাম। এভাবে দুই গ্রাম পার করে এক মসজিদে পেলাম লাশবাহী খাট। সেই খাটেই তাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেলাম। কিন্তু ওইদিনই আবার বিকেলে আরো বেশি মুক্তিযোদ্ধা এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে ব্রিজ আক্রমণ করি।  সন্ধ্যা নাগাদ প্রায় ঘণ্টা দুয়েক চলে সেই যুদ্ধ। পাকবাহিনীর ৭-৮ জন নিহত হয়। আমাদের হারুন ও মোতালেব শহীদ হয়, বেশ কয়েকজন আহত হয়। জয়পরাজয় যা-ই হোক, এটাই ছিল নরসিংদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম বড় আকারের সম্মুখ সমর। এই যুদ্ধের ফলে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতাস্পৃহা ও মনোবল বৃদ্ধি পায়।

এই যুদ্ধের পরে নেভাল সিরাজ-ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে আরো কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে এবং ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে পাকবাহিনীর শান্তি বিঘ্নিত করে তটস্থ রাখা হয়েছিল। এরকম একটি ‘হিট অ্যান্ড রান’ আক্রমণে আমি নিজেও একবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসি। সেদিন ছিল ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১। পাঁচদোনা ব্রিজ থেকে পলায়নপর পাকসেনাদের একটি দলের সঙ্গে আমাদের পুনরায় যুদ্ধ হয়। ২১ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে, ২ জনকে হত্যা করা হয় এবং বিজয়ের মাধ্যমে সেদিন নরসিংদীকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। পাঁচদোনা যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহমেদ মেজর হায়দারের মাধ্যমে সেই ১৯ জন পাকসেনাকে ঢাকার রমনা থানায় জমা দেন।

যখন ভারতীয় মিত্রবাহিনী সেই ব্রিজ দখল করল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমিই ভারতীয় ক্যাপ্টেনকে বলি, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা, এখানে আমি আর আমার ভাইয়েরা যুদ্ধ করেছি, এখানে তাদের বুকের রক্ত ঝরেছে, তারা কেউ আহত হয়েছে, কেউ শহীদ হয়েছে।’ তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, তোমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই তো আজ দেশ স্বাধীন হচ্ছে। তারপর তিনি একটি ম্যাপ বের করে জানতে চাইলেন, এখান থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ডাঙ্গা গ্রাম পর্যন্ত মুক্ত কিনা? আমি বললাম, শুধু মুক্তই নয়, আমাদের সম্পূর্ণ দখলে, ডাঙ্গাতে আমাদের ক্যাম্পও আছে। তিনি আমার সাহায্য চাইলেন। আমি তাকে ডাঙ্গা গ্রামে নিয়ে গেলাম। সেখানে একরাত থেকে তারা এগিয়ে গেল ঢাকার দিকে, চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে, ১৬ ডিসেম্বরের প্রতীক্ষিত সোনালি সূর্যোদয়ের দিকে।

আজ যখন পেছনে তাকাই, তখন যুদ্ধসময়ের পাঁচদোনা ব্রিজের চারপাশের বিভীষিকাময় নিঃসর্গ, অসংখ্য গুলির চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জামগাছ, আর আমার আশ্রয়স্থল নির্জন দুপুরে ঘাটে বাঁধা নিঃসঙ্গ নৌকা খুব মনে পড়ে। আর মনে করি আমার দুজন প্রিয় শহীদের কথা— হারুন ও মোতালেব! স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে আজ ভাবি অপার সম্ভাবনাময় এই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১