আপডেট : ০৫ December ২০২০
শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও আজ তারা সাধারণ মানুষের কাতারে শামিল হয়েছে নিজেদের যোগ্যতায়। নিজের চেষ্টা আর দৃঢ় মনোবল তাদের এতো দূর আসতে সহায়তা করেছে। সারা বিশ্বে বছরের একটি দিন তাদের উদ্দেশ্য করে পালন করা হয়। প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বরকে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই এই দিবসটির সূচনা। বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী দিবসের অনুগামিতার পেছনে আছে এক ঘটনাবহুল জীবনস্মৃতি। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বেলজিয়ামে এক সাংঘাতিক খনি দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যান। আহত পাঁচ সহস্রাধিক ব্যক্তি চিরজীবনের মতো প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাদের প্রতি সহমর্মিতায় ও পরহিতপরায়ণতায় বেশ কিছু সামাজিক সংস্থা চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজে স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে এগিয়ে আসে। এর ঠিক পরের বছর জুরিখে বিশ্বের বহু সংগঠন সম্মিলিতভাবে আন্তর্দেশীয় স্তরে এক বিশাল সম্মেলন করেন। সেখান থেকেই প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্যের হদিশ মেলে। সেখানে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবন্ধী কল্যাণে বেশকিছু প্রস্তাব ও কর্মসূচি গৃহীত হয়। খনি দুর্ঘটনায় আহত বিপন্ন প্রতিবন্ধীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালন করতে আহ্বান জানানো হয়। সেই থেকেই কালক্রমে পৃথিবীর প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দিন হয়ে ওঠেছে। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে আমাদের দেশেও। এদের মধ্যে একজন বেলাল উদ্দিন। যিনি মনের জোড়েই নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিশ্ব জয় করেছেন। দুই হাতে ভর করে চলছেন একাকী। ১৯৯৩ সাল, বেলালের বয়স তখন ১৩ বছর। বন্ধুদের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে যাবার পথে নেমে আসে এক দুঃস্বপ্ন। ট্রেনে কাটা পড়ে চিরতরে হারান দুটি পা। চলার মতো অবলম্বন নেই তার। তারপরও থেমে যাননি। ২০০০ সালে বাবাকে হারিয়ে একা হয়ে পরলেও, পঙ্গুত্ব নিয়েই বেলালকে ধরতে হয় সংসারের হাল। পানের দোকান থেকে শুরু করে বিক্রি করেছেন সবজিও। গত বছর নগরীর বায়েজীদের রৌফাবাদে একটি অস্থায়ী দোকান দেন অদম্য এই যুবক। যেখানে মোবাইলের পাশাপাশি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম মেরামত করেন তিনি। তাতেই চলে মা, স্ত্রী আর দুই সন্তানসহ ৫ সদস্যের একটি পরিবার। বেলাল উদ্দিনের বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি থাকলেই প্রতিবন্ধীরাও পারে অনেক কিছু করতে। কারো করুণার পাত্র না হয়ে থাকতে চেয়েছেন বেলাল। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীরা ভিক্ষা না করে যদি কোনো কাজ করে খাই, তবে আমাদের দেশ আরো উন্নতি হবে। আরেকজন বুক থেকে পা পর্যন্ত প্যারালাইজড। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে হুইল চেয়ারের সাহায্যে চলাফেরা করছেন হেদায়তুল আজিজ মুন্না। তবুও থেমে নেই তার জীবন। হুইল চেয়ারে বসেই লড়ছেন, অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন সব প্রতিবন্ধীদের। প্রতিবন্ধিত্ব তার কাছে প্রতিবন্ধকতা নয় বরং এগিয়ে চলার শক্তি। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই যুবক নিজের যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে সুস্থ-সবলদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন প্রতিবন্ধীরা বোঝা নয় বরং সম্পদ। ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সম্মাননা লাভ করেন মুন্না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে সম্মানা স্মারক তুলে দেন। মুন্না একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিয়ে ২০০৩ সালে সৌদি আরব যান। সেখানে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও ছিল তার। চাকরি-ব্যবসা মিলিয়ে ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল কর্ড ইঞ্জুরির ফলে পঙ্গু হতে হয় তাকে। তখনই হয়তো তার জীবন থেমে যেতে পারত। কিন্তু মুন্নার ইচ্ছাশক্তি তাকে নিয়ে গেছে সাফল্যের শিখরে। দুর্ঘটনার পর ২২ দিন কোমায় ছিলেন মুন্না। পরবর্তীতে পারিবারের সিদ্ধান্তে তাকে দেশে এনে প্রথমে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর সাভারের সিআরপিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তার মনোবলের কাছে হেরে যায়। ক্রীড়াখাতে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন থেকে একটি হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট সিরিজে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ভারতের হুইল চেয়ার ক্রিকেট দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও অর্জন করে ওই ক্রিকেট দলটি। দলটির একজন অন্যতম সদস্য মুন্না। খন্দকার নাফিউর রহমানের বয়সটা কেবল ২০। জন্মের সময় থেকেই সংগ্রামের মধ্যে জীবন পাড়ি দেয় ছেলেটি। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে জন্মগ্রহণ করে নাফিউর। তার মা নাদিয়া আক্তার একজন গৃহিণী। বাবা খন্দকার মাহবুবুর রহমান মুদি দোকানদার। তাদের বাড়ি হাটচন্ডা গ্রাম, জামালপুর সদর, জামালপুরে। ছোটবেলা থেকেই নাফিউর রহমান ছিল অবহেলার পাত্র। নাফিউররা যমজ ভাই-বোন। জন্মের সময় এক পা ছাড়াই জন্মায় সে। সারা গ্রামে এ খবর রটে যায়। গ্রামের মানুষ মনে করত যে ছেলেটির জন্মই এক পা ছাড়া, সে জীবনে কতটুকুই পা চলতে পারবে। কিন্তু মানুষের অবজ্ঞায় সে-ই পিছিয়ে পড়ে, যে হারার জন্য ধরণীতে আসে। আর যারা মানুষের অবজ্ঞাকে নিজের শক্তিতে পরিণত করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, সে-ই বিজয়ী হয়। নাফিউর দ্বিতীয় পন্থাটিই বেছে নিয়েছিল। নাফিউরের বাসার সামনেই বিদ্যালয়। নাফিউরের বয়স যখন চার, তখন হামাগুঁড়ি দিয়েই বিদ্যালয়ের দিকে যেত সে। এলাকার সবাই অবাক হয়ে যেত। তার মা নাদিয়া ছেলের বিদ্যালয়ের প্রতি এত ভালোবাসা দেখে নিজেই বাঁশ কেটে দুটি লাঠি বানিয়ে দেন। নাফিউর সেই লাঠির ওপর ভর করে উঠে দাঁড়ায়। প্রথমদিকে ছেলেটির দাঁড়াতে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু অদম্য ইচ্ছায় লাঠির ওপর ভর করে হাঁটতে শিখল সে। এভাবে নাফিউর স্কুলে যাওয়া শুরু করল। তার এ প্রচেষ্টায় প্রশংসা তো দূরে থাক, উল্টো তাকে নিয়ে উপহাস আরো বেড়ে যায়। অনেকে বলতে লাগল, এভাবে এই ছেলে আর কতদূর আগাবে। রাস্তায় অনেক ছোটরা দেখে ভয় পেত। তখন নাফিউর আবার হতাশ হয়ে পড়ত। মনে একরাশ অভিমান জমে থাকত তার। তাও মুখ বুজে সব সহ্য করত সে। নাফিউর দেখত তার বন্ধুরা সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসছে। তা-ই দেখে নাফিউর ভাবতো- ইস, আমি যদি সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে পারতাম, তাহলে কি মজাই না হতো! ক্লাস নাইনে জামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে। নাফিউরের চাচা তাকে একটি ছোট্ট সাইকেল কিনে দিলেন। প্রথমে সাইকেলে উঠতে গিয়ে ব্যালান্স ঠিক রাখতে না পারায় বার বার পড়ে যাচ্ছিল সে। পরে তার চাচা তাকে সাইকেলের পেছনে ধাক্কা দিত আস্তে আস্তে, যাতে নাফিউরের সাইকেল চালানোয় অসুবিধা না হয়। এ কাজেও সফল হয় অদম্য জেদী ছেলেটি। স্কুল থেকে এসে প্রতিদিন নাফিউর সাইকেল চালানো কসরত করত। হাইস্কুলে থাকতেই সাঁতারে পটু হয়ে ওঠে সে। জামালপুর জেলার হাইস্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হয় ছেলেটি। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি তীব্র ঝোঁক ছিল ছেলেটির। জামালপুর জেলা স্কুল মাঠে ছেলেরা যখন ক্রিকেট খেলত, তখন নাফিউরের খুব ইচ্ছে করত বোলিং করার। একদিন সাহস করে বল করেও ফেলে। তার বোলিং দেখে অবাক হয় সবাই। এভাবে ‘জামালপুর নতুন আলো ক্রিকেট একাডেমি’তে খেলতে থাকে নাফিউর। এরই মধ্যে ‘রবি-খোঁজ, দ্য এক নম্বর স্পিনার’-এ জামালপুরে সেরা ২০ স্পিনারের মধ্যে জায়গা করে নেয় সে। ময়মনসিংহ বিভাগের প্রতিবন্ধীদের মধ্যে সেরা স্পিন বোলার নির্বাচিত হয়। এরপর বাংলাদেশ হুইল চেয়ার ক্রিকেট টিমে যোগদান করে। বাংলাদেশ প্যারা ব্যাডমিন্টন দলেও খেলা শুরু করেছে নাফিউর। ২০২১ সালে অলিম্পিক প্যারা ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টেও ছেলেটি নিজের ঝলক দেখাবে। সাইকেল ছেড়ে মোটরসাইকেল চালনায় পারদর্শী ছেলেটি। ২০ বছর বয়সী নাফিউর স্বপ্ন দেখে নিজেকে দেশের তরে বিলিয়ে দেবেন। সে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটে, মোটরসাইকেল চালনায়, সাঁতারে, ব্যাডমিন্টনে একজন সাধারণ মানুষের চাইতেও বেশি ঝলক দেখাচ্ছে নাফিউর। সে দেখিয়ে দিয়েছে একজন মানুষ চেষ্টা করলে কী না পারে! নাফিউর জানায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার মতো অনেকেই আছে, যারা নিজেদের মেধার প্রকাশ ঘটাতে পারছেন না। তাদের যদি তুলে আনা যায়, ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় তাহলে তারাও বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে। ...(চলবে)
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১