বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১২ October ২০২০

বৈষম্য কমানো ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়


মো. ফুয়াদ হাসান

 

পৃথিবীতে ব্যবধান বা বৈষম্য কিন্তু নতুন কিছু নয়। মানুষ থেকে শুরু করে পশুপাখি, জীবজন্তু সকলের মধ্যেই ব্যবধান আছে। ব্যবধান বা বৈষম্য মূলত শুরু হয় অর্থ-সম্পদ, বংশমর্যাদা, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো, শক্তিমান ও দুর্বলের মাঝে। ‘মাৎস্যন্যায়’-এর কথা আমরা সবাই শুনেছি। মাছের জগতে বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খায়। এর বিপরীত কিন্তু আমাদের সমাজেও নয়। পৃথিবীতে ব্যবধান বা বৈষম্যর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় অনেক আগে থেকে। সমাজ-ইতিহাসের পাতা যত পুরনো বৈষম্য বা ব্যবধানের ইতিহাসও ততটা পুরনো। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৫৪১ মার্কিন ডলার। এটি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে ১৭৫১, ২০১৯ সালে ১৯০৯ এবং ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২০৬৪ মার্কিন ডলারে। মাথাপিছু আয়ের এই ক্রমাগত বৃদ্ধি প্রশংসনীয়। কিন্তু মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধির চোরাবালিতে যেভাবে  প্রতিনিয়ত আয় বৈষম্য বেড়েই চলেছে সেটা মোটেই সুখকর নয়। কারণ একজন খেটে খাওয়া মানুষ ও একজন শিল্পপতির জীবনযাত্রার মান কখনো এক হতে পারে না। অর্থশাস্ত্রে আয় ও সম্পদ বণ্টনে অসমতা বা বৈষম্য বুঝাতে জিনি সহগ (অনেকে গিনি বলে) ব্যবহার করা হয়। এটা মূলত বৈষম্য পরিমাপ করতে ব্যবহার করা হয়। ১৯২২ সালে ইতালীয় পরিসংখ্যানবিদ কোররাদো জিনি সহগ (‰ini Coefficient) উদ্ভাবন করেন। এটা অনুপাত বা ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা হয়। এর মান ০ থেকে ১ পর্যন্ত হয়। জিনি সহগের মান কম হলে আয় ও সম্পদ বণ্টনে অপেক্ষাকৃত সমতা বোঝায়। অন্যদিকে জিনি সহগের মান বেশি হলে আয় ও সম্পদ বন্টনে অসমতা বোঝায়। সহগের মান শূন্য হলে চরম সমতা (সবার আয়-ব্যয় সমান) এবং সহগের মান একক হলে চরম আসমতা (এক জনের হাতে সব সম্পদ) বোঝায়। সহগের মান শূন্য হতে যতই একের দিকে যাবে ততই অসমতা বোঝাবে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগের মান ছিল মাত্র দশমিক ৩৬। ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ৪৮-এ। বর্তমানে ভারতে ০.৪৬ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ০.৪৮৫ পয়েন্ট। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আয় বৈষম্য রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাতে দশমিত ৬৩। সিপিডির তথ্য মতে, করোনার কারণে ভোগের বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৩৫-এ। ২০১৬ সালে তা ছিল দশমিক ৩২। একই ভাবে আয়ের বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৫২ পয়েন্টে। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী যা ছিল দশমিক ৪৮ পয়েন্টে। সাধারণত কোনো দেশে  সহগের মান দশমিক ৫০ পার হলেই সে দেশকে উচ্চ আয়ের বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয় এবং সেসব দেশের বৈষম্যকে মহাবিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করা হয়। এখন বাংলাদেশও সেই পথে যাচ্ছে।

সম্প্রতি দৈনিক কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে জিনি সহগে বাংলাদেশর অবস্থান দশমিক ৮ শতাংশ (সূত্র : কালের কণ্ঠ ১৭/০৯/২০২০)। ধনীরা আরো ধনী এবং গরিব আরো গরিব হচ্ছে। কিছু সংখ্যক মানুষ সফলতার মহাশূন্য পাড়ি দিচ্ছে, অন্যদিকে বৃহৎ জনগোষ্ঠী তলানিতে পড়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে গরিব ২০ লাখ পরিবারের প্রতি মাসে গড় আয় মাত্র ৭৪৬ টাকা। আর সবচেয়ে ধনী ২০ লাখ পরিবারের গড় আয় ৮৯ হাজার টাকা। তাদের মতে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে।  বিপরীতে একই সময় সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে, সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের সম্পদ ২০১০ সালে ছিল দেশের মোট সম্পদের দশমিক ৭৮ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা কমে নেমে এসেছে দশমিক ২৩ শতাংশে। অন্যদিকে, ২০১০ সালে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের সম্পদের পরিমাণ ছিল দেশের মোট সম্পদের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১৬ সালে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশে। বিবিএস বলছে, দেশের মানুষের যত আয় তার ৩৮ শতাংশই হলো সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের। আর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশের হাতে মাত্র ১ শতাংশের মতো আয়।

গত বছরের শেষে চীনের উহান থেকে শুরু হয় করোনার নির্মম তাণ্ডব বাংলাদেশে শুরু হয় চলতি বছরের মার্চ থেকে। ক্রমাগত লকডাউনের মাধ্যমে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার ফলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পরে খেটে খাওয়া, তৃণমূল মানুষগুলো। এক বেলা অন্ন জোগানো তখন হয়ে দাঁড়ায় এক মহাকর্ম। আর ঠিক এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, করোনা মহামারী চলাকালে এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে তিন হাজার ৪১২ জন। আর গত এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ জন। সব মিলিয়ে গত জুন শেষে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ছাড়িয়েছে।  ২০০৯ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২১ হাজার ৪৯২। অর্থাৎ গত ১১ বছরে দেশে কোটিপতি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬৪ হাজার (সূত্র : কালের কণ্ঠ ১৭/০৯/২০২০)। ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র ৫ জন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। আর ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৮৭ জনে।

এভাবে প্রতিনিয়ত ধাবমান গতিতে ধনী বা কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশের মোট সম্পদের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে গুটি কয়েক মানুষের হাতে। অন্যদিকে বৃহৎ  জনগোষ্ঠীর হাতে থাকছে ভগ্নাংশ মাত্র। ফলে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবাধন আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে, যা দেশের জন্য মোটেই মঙ্গলকর নয়। দেশের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে দীর্ঘ মেয়াদি টেকসই উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরে সকল ক্ষেত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।  সর্বোপরি দেশের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে দ্রুত বর্ধমান এই বৈষম্য বা ব্যবাধন কমনোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১