আপডেট : ৩০ March ২০১৯
‘পরাবাস্তবতা’ হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্তবতা যে বাস্তবতার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোনো মিল নেই। আবার কিছু মিল থাকতেও পারে অবশ্য। ইংরেজিতে ‘সুররিয়েলিজম’ বলা হয়। বস্তুত চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক ধারণা মিলানো যায় এখানে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডী ভাবনা মানুষ অবচেতন মনে অনেক কিছুই করে বা ভাবে। তিনি বলেন, এ ভাবনা চেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনেরই বেশি। পরাবাস্তবতা হচ্ছে মানুষের চেতনটা যখন শিথিল হয় তখন মানব মনে অবচেতন প্রভাব ফেলে। এটি হচ্ছে কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পসমূহের মধ্যে যোগসূত্র। মূলত সুইজারল্যান্ড থেকে উঠে আসা ‘ডাডাইজম’-এর পরবর্তী আন্দোলন হচ্ছে ‘সুররিয়েলিজম’ বা ‘পরাবাস্ততা’। এখন আবার যা ‘জাদুবাস্তবতা’ বলছেন অনেকে। ক. জানতাম তোমার চোখে একদা জারুলের বন খ. ... সোনার ঘাসের পাতা ঘুমের মতো গ. নদীর ভিতরে যেন উচ্চ এক নদী স্নান করে। ঘ. দেখেছি ঘাসের মেঝে ছিন্ন আবদুল মান্নান সৈয়দ বলতেন— সুররিয়ালিজমই হলো প্রকৃত বাস্তবতা। তিনিও কবিতায় সার্থক পরাবাস্তবতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তাঁর প্রথম কাবিতাগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র (১৯৬৭) ভেতরে সুররিয়ালিজমের সার্থক প্রয়োগ আমরা দেকতে পাই। তিনি জীবনান্দ দাশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা লিখেছেন এবং গবেষণা করেছেন। আর এ কারণে জীবনান্দ প্রভাব বিস্তার করেছে কবির মনে। আবু আফজাল মোহা. সালেহ
মার্ক আর্নেস্টের সংজ্ঞা আমরা তুলে ধরতে পারি। তিনি বলেছেন, সুর রিয়ালিস্টের লক্ষ্য হচ্ছে অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকাও সৃষ্টি করা নয়। এর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সাথে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেওয়া।
ইতালিতে জন্মগ্রহণ করা ফ্রেঞ্চ আপোলিনিয়ার (১৮৮০-১৯১৮) ‘সুররিয়ালিজম’ শব্দটি উল্লেখ করেন। তাঁর লেখা কবিতায় আদি-সুররিয়ালিজম কাব্যের নিদর্শন রয়েছে। ‘টাইরেসিয়াম-এর স্তন’ নাটকে প্রথম সুররিয়ালিজম প্রয়োগ করেন তিনি। পরে তা ইংরেজি ও জার্মান সাহিত্যেও এ ধারা সম্প্রসারণ হয়। ‘চাঁদের আলো’ কবিতায় তিনি পরাবাস্তবতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন এভাবে— ‘ক্রোধীর ঠোঁটে শ্রবণসুখকর চাঁদ/আর রাতের লোভার্ত নগর ও উদ্যান/মৌমাছির মতো নক্ষত্রদের ভ্রম হয়/এই আলোকময় মধুতে আঙুরবাগান আহত/আকাশ থেকে ঝরছে মধুর মধু/চাঁদের রশ্মি যেন মধুর ঝিকিমিকি/...হাওয়ায় গোলাপে মিশছে মধুর চন্দ্রিমা।’
এল দুয়ার, সালভার দালি, চিত্রশিল্পী পল ক্লে, নেরুদাসহ অনেকে সুররিয়েলিজম কবিতা লিখেছেন বা সাহিত্য রচনা করেছেন। বাঙলা সাহিত্যে অনেক কবিই পরাবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ করেছেন। বর্তমানকালের প্রায় সব কবিই ‘পরাবাস্তবতা’র প্রয়োগ করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুলও কবিতা কিংবা গানে পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, শক্তি চট্টপাধ্যয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রয়োগ ঘটান।
আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি বিষ্ণু দে তাঁর ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ কবিতাগ্রন্থে প্রথম সার্থক সুররিয়েলিজম বা পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেন। তবে পরাবাস্তবতার উপাদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর ‘ঝরাপালক’, ‘বনলতা সেন’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যে পরাবাস্তবতার ব্যবহার অনেক বেশি। তাঁকে ‘পরাবাস্তবতার কবি’ বলা হয়ে থাকে। পরাবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। কবিতায় পরাবাস্তবতার কয়েকটি উদাহরণ :
ফেলেছে সমপন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি
শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ (কোন এক পরিচিতাকে, শামসুর রাহমান)
অজস্র পাতার ফাঁকে হূদয়ের নদী হয়ে চাঁদ নামে ঘাসে’ (অনেক আকাশ, সৈয়দ আলী আহসান)
তিতাসের স্বচ্ছ জলে প্রক্ষালণে নেমেছে তিতাসই।
নিজের শাপলা লয়ে নেমে নদী নদীর ভিতরে
ঠাট্টা বা বিদ্রূপ নেই, শ্যেনচক্ষু, নেই চারণের বালি।
(নদীর ভিতরে নদী, আল মাহমুদ)
লাল মুণ্ডু নিয়ে খেলে বিনা অপব্যয়ে
সূর্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি।
(কবিতা : রাত্রিপাত, আবদুল মান্নান সৈয়দ)
আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক কবিতা একুশ শতকের মানুষের দিনযাপনের নানা সংশয়, সংকট, রিংরংসা ঘিরেই আবর্তিত হয়ে থাকে। ফলে পরাবাস্তবতার গন্ধ পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার নয়। আর তাই বর্তমান সময়ের কবিদেরও কবিতায় আমরা পরাবাস্তবতা বা জাদুবাস্তবতার সুনিপুণ প্রয়োগ দেখে থাকি। আসলে আধুনিক কবিতায় গতিশীলতা আনতে পরাবাস্তবতার কাছে যেতেই হবে। আর উত্তরাধুনিক কবিতায় এর চাহিদা আরো বেশি।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১