আপডেট : ০৭ January ২০১৯
যদিও গত বছরের ঘটনা, তবুও নতুন বছরের বই উৎসবের কোলাহলে মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছি না অরিত্রির কথা। অরিত্রির জন্য লিখতে বসে হাত সরছে না। পনেরো বছরের একটা মেয়ে সে কি না বলি হলো আমাদের শিক্ষাঙ্গনের চরম অব্যবস্থাপনার! কয়েকজন নিষ্ঠুর নির্দয় শিক্ষকের নির্মমতায় আত্মাহুতি দিতে হলো গলায় ওড়না পেঁচিয়ে। নিজের অপমান সইতে পেরেছিল, পিতা-মাতার অপমান সইতে পারেনি। পারার কথাও না অতটুকু একটা আবেগী মেয়ের। ওই বয়সটাই তো আবেগের, না ভেবে কিছু করার, তাতে যদি তাকে প্ররোচিত করা হয় সে তো করবেই। অরিত্রির মৃত্যুর পর থেকে দিন-রাতগুলো স্বভাবতই অনিদ্রায় কাটাচ্ছি। মনে পড়ছে আমার ছেলেবেলার সেই আদর্শবান সংবেদী শিক্ষকদের কথা। তাদের হয়তো বড় বড় ডিগ্রি ছিল না, কিন্তু শিক্ষাদানে কোনো ফাঁকি ছিল না। আমরা ছিলাম তাদের সন্তানতুল্য। কোচিং বাণিজ্য ছিল না। বাবা-মায়ের শিক্ষকদের পেছনে ছোটাছুটি, তাদের খুশি করানোর পাঁয়তারা ছিল না। তখন ছিল নির্ভেজাল একটা শিক্ষাব্যবস্থা। অরিত্রির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে মোবাইল ফোনে পুরো বই তুলে এনে নকল করছিল! আবার এমনও শোনা গেছে, সে পরীক্ষা শেষে মোবাইল দিয়ে ড্রাইভারকে ডাকছিল। অরিত্রির বাবা-মা বলেছেন, তাদের মেয়ে নকল করেনি। আসলে কী ঘটেছিল তা বলার জন্য অরিত্রি এখন আর নেই। অরিত্রির অপরাধে অভিভাবককে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বাবা মা আর অরিত্রি শিক্ষকদের কাছে অনুনয়-বিনয় করেছিল, মাফও চেয়েছিল। অরিত্রি শিক্ষকের পা জড়িয়ে ধরেছিল। তারপরও কেন তাকে টিসি দেবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল- এটা বিস্ময়কর। অবাক ব্যাপার, যদি অভিভাবকের আর্জি বিবেচনা না করা হয়, তাহলে অভিভাবককে ডেকে পাঠানো হলো কেন? কারণ উল্লেখ করে চিঠি দিয়ে স্কুল টিসি দিতে পারত। অভিভাবক ডাকা মানে আলোচনার সুযোগ এবং সংশোধনের সুযোগ দেওয়া অথবা সতর্ক করা। তা যখন নেই, তাদের ডেকে পাঠিয়ে অপমান করে মাফ চাওয়ানোর মতো নিগৃহীত কাজ স্কুল কর্তৃপক্ষের করার কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। সন্তান এবং অন্য লোকদের সামনে এমন অসম্মানজনক কাজ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষক করতে পারে না। প্রধান শিক্ষক তাদের রুম থেকে বের করে দিয়েছিল। অভিভাবকদের রুম থেকে বের করে দেওয়ার অধিকার কি তিনি রাখেন? তারা কেন মনে রাখেন না, ছাত্ররা ভর্তি হয়, পড়তে আসে বলেই তাদের বেতনে স্কুল চলে। সে কারণেই সরকার পয়সা দেয়। আর সে কারণেই তারা ওই ভারি পা-ওয়ালা চেয়ারটায় বসেন। যদি ধরেই নিই অরিত্রি পরীক্ষায় নকল করছিল, সে মোবাইলে পুরো বই তুলে এনেছিল, তাহলে যে স্কুলে এত কড়াকড়ি, সে স্কুল পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে মোবাইল আছে, তা কেন চেক করা হলো না। যদি না করে থাকে সে দায়ভার তো স্কুল কর্তৃপক্ষের। ওর কাছে মোবাইল আছে কি না এটা যে চেক করা হলো না, এজন্য যে বা যারা দায়ী তারা এখন কী করবেন? ভুল স্বীকার করবেন, না সাজা ভোগ করবেন? ভিকারুননিসার ভালো স্কুল হিসেবে নাম আছে, বদনামও কম নেই। এই সেই স্কুল যে স্কুলে শিক্ষক পরিমল ছাত্রীর সাথে অশালীন আচরণের জন্য জেল খেটেছিল। আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছিল। তারপরও আমাদের বাবা-মারা ক্রেজি ওই স্কুলেই পড়াতে হবে। তা মেধা দিয়ে হোক, তদবির করে হোক কিংবা ডোনেশন দিয়ে হোক। এই জাতীয় নোংরামি করতে সিংহভাগ অভিভাবক পিছপা হন না। ওই স্কুল যদি এতই ভালো তাহলে অরিত্রির পুরো বই কপি করতে হলো কেন! স্কুল কি তাকে এক পাতাও পড়ায়নি? না পড়ানোর দায় কার? স্কুল কর্তৃপক্ষ হয়তো বলবে, পড়িয়েছেন, মেয়ে মেধাহীন। তা এমন মেধাহীন মেয়ে এত নামকরা স্কুলে ভর্তি হলো কী করে? ভর্তির কি কোনো মানদণ্ড নেই? তাহলে ভর্তি পরীক্ষার প্রয়োজন কী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার নিয়মনীতি অনুযায়ী চলবে একটা সার্বজনীন পদ্ধতিতে অনুসরণ করে। মেধাভিত্তিক ভর্তির সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ডোনেশন প্রথায় তো আর মেধা লালন সম্ভব নয়। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ। কানমলা, বেতমারা, স্কেল দিয়ে মারা, বেঞ্চে দাঁড় করানো, নিল ডাউন থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের শারীরিক এমনকি অপমানজনক শাস্তি দেওয়া নিষেধ। বিধান অনুযায়ী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন সঙ্কুচিত হয় এমন শাস্তি বা অপমান করা যাবে না। একইভাবে কটু কথা বলা, ধর্ম নিয়ে কথা বলা, বাপ মা তুলে কথা বলা, মনে আঘাত লাগে এমন কোনো কথা বলা নিষিদ্ধ। কিন্তু এই নিষিদ্ধ কাজগুলো সিদ্ধ করতে আমাদের এক শ্রেণির শিক্ষকের জুড়ি নেই। ‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা’, ‘সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলাও আপিল বিধিমালা’ দুটোতেই এই জাতীয় কাজ শিক্ষকের শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য। এ বিষয়ে ২০১১ সালের ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিতকরণ সংক্রান্ত বিধিমালা’ও রয়েছে। কিন্তু তাতে এ কাজ বন্ধ হয়নি। এক শ্রেণির শিক্ষক আইন কানুনের তোয়াক্কা করছেন না। তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কী। আইন অমান্য করার অপরাধে শিক্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে এই অপরাধপ্রবণতা থামবে না। আর যে শিক্ষকরা আইন বা নিয়ম মেনে চলেন না তারা শিক্ষার্থীদেরকে কী শেখাবেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। শিক্ষার্থীদের ওপর জুলুমবাজির এমন ঘটনার বিচার না হওয়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের হতাশা ও ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। অরিত্রি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এর আগে একই কারণে আত্মহত্যা করেছে মাদারীপুরের সাথী আক্তার, ভাটারার হোসেনসহ অনেকে। ওরা আত্মহত্যা না করলে আমরা বিষয়টা জানতেই পারতাম না। যেমন প্রতিদিনই কোনো না কোনো অভিভাবক এভাবে অপমানিত হচ্ছেন, চেপে যাচ্ছেন, আমরা জানতেও পারছি না। অরিত্রি আত্মহত্যা করল, জানাজানি হলো, আমরা জানলাম। তার সহপাঠীরা ছয় দফা দাবিতে অবস্থান নিলো স্কুলের সামনে রাস্তায়, ক্লাস বর্জন করল। যে প্রধান শিক্ষক দুদিন আগে বলেছিলেন, যা করা হয়েছে স্কুলের নিয়ম মেনেই করা হয়েছে, তিনিই মাফ চাইলেন। ফেসবুকের পাতায় পাথায় ঘুরতে লাগল সে ছবি। অরিত্রির বাবা প্রধান শিক্ষক নাজনীন ফেরদৌস, শাখাপ্রধান জিনাত আখতার ও শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে আসামি করে পল্টন থানায় মামলা করলেন। শিক্ষামন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করলেন, তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হলো, তাদের এমপিও বাতিল হলো। তদন্ত চলছে। শ্রেণিশিক্ষিকা হাসনা হেনা গ্রেফতার হয়েছেন। অপর দুই শিক্ষকের খোঁজ করছে পুলিশ। হাইকোর্ট বললেন, ‘এ ঘটনা হূদয়বিদারক।’ ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক দাবি এখনো পূরণ হয়নি। তারা চেয়েছে যেন শিক্ষায়তনে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন না করা হয়। যেন কথায় কথায় টিসি দেওয়ার হুমকি দেওয়া না হয়। পরিচালনা পর্ষদের অপসারণও দাবি করেছে তারা। নাজনীন ফেরদৌস দীর্ঘদিন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কেন? এত নামকরা একটা স্কুল সেখানে কেন একজন যোগ্য লোককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। আমি নাজনীন ফেরদৌসকে অযোগ্য বলছি না। বলছি তিনি ভারপ্রাপ্ত, প্রধান নন। আর ভিকারুননিসা পরিচালনা পর্ষদ চেষ্টা করছে, প্রধান শিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত কাউকে পাচ্ছে না এমনটাও শুনিনি। এই যে দাবি পূরণ হলো বা হলো না, তাতে অরিত্রি বা অরিত্রির পরিবারের কী এলো গেল। অরিত্রি কি আর ফিরে আসবে! অরিত্রির বোন একই স্কুলে পড়ে। সে কী করে এই স্কুলে পড়বে? সে কি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারবে তার বোনের করুণ মৃত্যুর কথা! যারা বলছেন, অরিত্রি ভুল করেছে, সে কেন প্রতিবাদ করল না, তাদের বলি, আপনারা সংবেদনশীল হোন। একবার ভাবুন ওর বয়সটা। ওটা কি ওর প্রতিবাদের বয়স। নিজের অপরাধে (?) বাবা-মায়ের অপমান সইবার মতো বয়স কি ওর হয়েছিল! প্রিয় অভিভাবকগণ, হুঁশে আসুন। বড় স্কুল বা নামকরা স্কুলে সন্তানদের পড়ানোর চেয়ে পড়াতে চেষ্টা করুন মানবিক স্কুলে (অবশ্য যদি থেকে থাকে)। এদেশের গ্রাম গঞ্জের সাধারণ স্কুলের সাধারণ শিক্ষকদের হাত থেকেই কিন্তু বেরিয়ে এসেছে দেশের সেরা সন্তানরা। প্রিয় সন্তানরা তোমাদের বলি, জীবন অত তুচ্ছ ব্যাপার নয়। কোনো একটি স্কুলের একটি টিসির মধ্যেই জীবন সীমাবদ্ধ নয়। জীবন অসীম, অনন্ত সম্ভাবনাময়। কেন বোঝ না, বাবা-মায়ের তোমাদের দরকার, সমাজের আর দেশের তোমাদের দরকার। অরিত্রি, বোকা মামণি আমার, এমনটা কেন করলে! তোমার জন্য চোখের জল ছাড়া আর কী দিতে পারি! সরকারের প্রতি প্রত্যাশা, শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজান। শিক্ষা ও আচরণের বিচারে শিক্ষকতার মানদণ্ড নির্ধারণ করুন। নিয়মিত মনিটরিং করুন স্কুলগুলো। তা না হলে হতাশাগ্রস্ত প্রজন্মকে আত্মহননের ভুল পথ থেকে আমরা বাঁচাতে পারব না। লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম-সচিব
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১