বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৫ January ২০১৯

ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ মহাসমুদ্রে বিএনপি


একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে বিস্মিত হননি, এমন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছে— এ সত্যকে মেনে এবং সবদিক বিবেচনায় রেখে যারা ধরেই নিয়েছিলেন যে, ভোটে বিএনপি জোট পরাজিত হবে, তারাও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছেন। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এবং বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল (১৯৯৬) হওয়ার গৌরবের অধিকারী এ দলটি এমন ফলাফল করবে তা কারো ধারণায় ছিল না। দল হিসেবে মাত্র পাঁচটি এবং জোট মিলিয়ে সাত আসন অধিকার করাকে কেউই সহজভাবে নিতে পারছেন না। বিএনপির এ ফল বিপর্যয় নিয়ে চলছে সর্বত্র নানামুখী পর্যালোচনা। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে— নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য বিএনপি গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যে জন্য জনগণ তাদের ভোট দেয়নি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নিজেদের ভুল ও দুর্বলতার কারণে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে।

নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপির অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। যারা দেশের বিগত নির্বাচনগুলোর ইতিহাস জানেন এবং একাদশ নির্বাচনকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাদের সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিজয় হতো— একথা ধরে নিলেও বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল এমন বিপর্যয়কর ফলাফল করবে তা প্রায় সবার কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কারণ বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এখন অত্যন্ত দুর্বল বলে বিবেচিত হলেও জনসমর্থনের বিচারে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। সে জনসমর্থনকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দলটি বিজয়ী না হলেও অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হওয়াটা কঠিন কোনো কাজ ছিল না। অথচ ফলাফলে দেখা গেল তারা সাকুল্যে পাঁচটি আসনে জয়ী হতে পেরেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা সবাই পরাজিত হয়েছেন। শুধু মহাসচিব একটি আসনে জিতেছেন। তাও নিজের আসনে নয়, জিতেছেন বগুড়ায় খালেদা জিয়ার আসনে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ধানের শীষ মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ২৫৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৫২ জনই তাদের জামানত হারিয়েছেন। এমন ফলাফল কেমন করে হলো তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

ফলাফল ঘোষণার পর ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচন দাবি করা হয়েছে। যদিও সে দাবি প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাৎক্ষণিকভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভোটের পরদিন বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের যে বৈঠকগুলো হয়েছে, সেগুলোতে একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিএনপি ঘোষণা করেছে তাদের দল থেকে নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন না। তবে গণফোরামের সদস্য দুজনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি। অবশ্য পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, বৃহত্তর সিলেট থেকে নির্বাচিত ওই সদস্যদ্বয়ের ওপর শপথ নেওয়ার জন্য তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নাকি চাপ রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলছে, শেষ পর্যন্ত গণফোরাম থেকে নির্বাচিতরা শপথ নেবেন এবং এ ইস্যুতে ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিএনপির এ নির্বাচনী বিপর্যয়ে বেশিরভাগ মানুষ সরকারের প্রবল দমননীতিকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন। তাদের এ পর্যবেক্ষণকে অসার বলার অবকাশ নেই। কেননা বিগত দশ বছর ধরে বিএনপি নেতাকর্মীরা সরকারের দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও তা ছিল অব্যাহত। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা ছিল বহুল আলোচিত; কিন্তু তার অনুপস্থিতি ছিল দিবালোকের মতোই দৃশ্যমান। মিছিল সমাবেশ তো দূরের কথা, নীরব গণসংযোগও করতে পারেনি দলটির প্রার্থীরা। সিইসি অবশ্য কখনোই স্বীকার করেননি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। বরং তিনি অত্যন্ত চমৎকার নির্বাচনী পরিবেশই দেখতে পেয়েছেন। সিইসির এ দেখা তার দৃষ্টিভ্রম, নাকি অজানা কারণে ক্ষমতাসীনদের প্রতি তার মমত্ববোধপ্রসূত তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে।

এছাড়া আলোচিত ‘গায়েবি মামলা’ দায়েরও ছিল অব্যাহত। ওইসব মামলায় আসামি করা হয়েছে এমনসব কর্মী-সমর্থককে, যারা নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কেউ খুঁজে পাননি।  ফলে বিএনপি প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে তাদের উপস্থিতি সম্ভবপর ছিল না সঙ্গত কারণেই। আর তাদের এ অনুপস্থিতিই সুযোগ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিশাল ও অবিশ্বাস্য ব্যবধানে বিজয়ী হতে। না হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যেখানে তিন লাখ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে বিএনপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা তিন হাজার— এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? বলা হতে পারে বিএনপির ভোটাররা কেন্দ্রে যাননি, তাই তাদের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট পড়েনি। যুক্তি হিসেবে এটা মন্দ নয়। তবে বিগত নির্বাচনগুলোর পরিসংখ্যান বিবেচনায় আনলে শুভঙ্করের ফাঁকি স্পষ্ট হয়ে যাবে।

যে পরিস্থিতিতে বিএনপির প্রার্থীরা ছিলেন, তাতে যদি তারা মাঝপথে নির্বাচন বর্জন করতেন, অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে— শতাধিক প্রার্থী ভোটের দুই-তিন দিন আগে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাস, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব ও প্রশাসনের বৈরী আচরণের অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের জন্য দলটির হাই কমান্ডকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলুর যে টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস হয়েছে— তাতেও দেখা যায় তারা উভয়েই নির্বাচন বর্জনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন তাতে সম্মত ছিলেন না, এটাও জানা যায় ওই কথোপকথন থেকে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে ফলাফলে তেমন একটা হেরফের হতো এমনটি নয়। এখন তারা পাঁচটি আসনের অধিকারী, তখন হয়তো একটিও থাকত না। অবশ্য ভোটের লড়াইয়ের ফলাফল বুঝতে পেরে তারা মাঠ ত্যাগ করেছে— আওয়ামী লীগের লোকজন এমন একটি কথা বলার সুযোগ পেয়ে যেত। যুক্তি হিসেবে এ কথাকে ফেলে দেওয়া যাবে না। কিন্তু ফলাফল অনুমান করার পরও অসম যুদ্ধে লিপ্ত থাকাটা কোন ধরনের চিন্তা-ভাবনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে দলটির নেতাকর্মীদের। 

ক্ষমতাসীনরা বলার চেষ্টা করছেন— বিগত দশ বছরে তারা যে উন্নয়ন করেছে, তাতে জনগণ অনুরক্ত হয়ে তাদের ভোট দিয়েছে। পাশাপাশি বিএনপির ‘নেতিবাচক’ কর্মকাণ্ডের ফলে দলটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এ ফল বিপর্যয়। এর কারণ হিসেবে তারা ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ লালন-পালন, ২০১৪ সালের লাগাতার অবরোধ আন্দোলনে পেট্রোলবোমাসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কথা বলছেন। এগুলোকে রাজনৈতিক ব্লেম গেমের অংশ হিসেবেই মনে করছেন অনেকে। বিএনপির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আগেও ছিল। কিন্তু তখন তো এমন ফল বিপর্যয় দেখা যায়নি! আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে আন্দোলন-সংগ্রামের যে চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ২০১৪ সালের আন্দোলন তা থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না। কিন্তু কথায় আছে— বিজয়ীদের সব কাজ হয়ে যায় বৈধ, আর পরাজিতদের কাজগুলো হয়ে যায় অপরাধ। বিএনপির দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনেই তারা সফল হতে পারেনি। এ ব্যর্থতা দলটিকে এখন দাঁড় করিয়েছে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখোমুখি।

ভোটের দিন কেউ কোথাও বিএনপির পোলিং এজেন্ট দেখতে পেয়েছেন— এমন সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নিজেও রাজধানীর অন্তত দশটি ভোটকেন্দ্র ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও পোলিং এজেন্ট দূরের কথা, পোলিং বুথের বাইরেও বিএনপি নেতাকর্মীদের দেখতে পাইনি। পরিচিতদের ফোন করে জেনেছি তারা বাসায় অবস্থান করছেন। ক্ষুব্ধ অনেকেই বলেছেন, কর্মীদের বলা হয়েছিল ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে। কিন্তু যেখানে নেতারাই লাপাত্তা, সেখানে কর্মীরা ঝুঁকি নিতে যাবে কোন সাহসে? অভিযোগ মিথ্যে নয়। ভোটের আগে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতারা এমন ভাষায় কথা বলতেন যেন জয় তাদের করায়ত্ত। তাদের দিকনির্দেশনা পালনের জন্য কর্মীদের আহ্বান জানানো হতো। কিন্তু পরিণামে দেখা গেল নেতারাই মাঠে থাকেননি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারেন। তিনি মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে স্ব-দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এলাকা ত্যাগ করার পর সেনাবাহিনী মাঠে নামার রাতে রওনা দিয়েছিলেন এলাকার দিকে। কিন্তু পথিমধ্যে পুনরায় আক্রান্ত হয়ে সেই যে পশ্চাৎপসরণ করেছেন আর এলাকামুখী হননি। এমন ঘটনা অনেক এলাকায়ই ঘটেছে। ফলে নেতাদের অনুপস্থিতিতে হতাশ কর্মীরা নীরবেই মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন নিরাপদ জায়গায়। কেউ কেউ বলতে পারেন নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত পক্ষপাতিত্বের এই নির্বাচনী মাঠে বিএনপি প্রার্থীদের থাকা কি সম্ভব ছিল? প্রশ্ন অমূলক নয়। যে পরিস্থিতি নির্বাচনী মাঠে ছিল, তাতে সরকারবিরোধী কোনো প্রার্থীর টিকে থাকা একেবারেই সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। যত প্রতিকূলতাই থাকুক, সামান্যতম প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টাও কি করা যেত না? যেভাবে ভোটের দিনটি পার হয়েছে, তাতে তা শান্তিপূর্ণই বলতে হবে। ছোটখাটো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি কোথাও হলেও বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি। ফলে সংঘর্ষ ছাড়াই ক্ষমতাসীনদের দখলে গেছে ভোটের মাঠ। অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সামনে এখন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ উত্তাল মহাসমুদ্র। সে মহাসমুদ্র দলটি কীভাবে পাড়ি দেবে সঙ্গত কারণেই তা আলোচনায় স্থান পাচ্ছে। যে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে দলটি নিপতিত হয়েছে, তা থেকে তারা উঠে দাঁড়াতে পারবে কি-না এ সংশয় রয়েছে অনেকের মনেই। টানা তৃতীয় দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া দল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সামনে আরো বেশি প্রতাপশালী হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। অন্তত অতীতের চিত্র তা-ই বলে। সে পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে বিএনপিকে টিকে থাকতে হলে যে কর্মকৌশল নিয়ে এগোতে হবে, দলটির বর্তমান নেতৃত্ব তাতে কতটা সফল হবেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১