বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৯ December ২০১৮

সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য


আজ রাত পোহালেই বহুল প্রত্যাশিত সেই দিন। আগামীকাল ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ হবে দেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা সবার। বাংলাদেশের জনগণ তো বটেই, বিদেশি বন্ধুরাও চান এবারের নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হোক। সবার প্রত্যাশার একাংশ পূরণ হয়েছে। কেননা নির্বাচনে দেশের নিবন্ধিত সব দল তো বটেই, অনিবন্ধিত দলগুলোও জোটের অংশীদার হয়ে বড় দল দুটির নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহার করে ভোটযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। তবে প্রত্যাশিত নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকে কি-না, তা নিয়ে অনেকেই সংশয়ে রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধীদলীয় প্রার্থী, বিশেষত বিএনপি প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধা দেওয়া, পোস্টারিং করতে না দেওয়া, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর, প্রার্থীদের ওপর হামলা, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, পুলিশের হয়রানি ইত্যাদি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ মৌখিক নয়, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের অভিযোগ করেছে বিএনপি।

এবারের নির্বাচনে সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কারণ তারা সরকারে আছে। ফলে অনেকটা চাপমুক্ত রয়েছেন দলটির প্রার্থীরা। গত দশ বছর সরকার পরিচালনায় নিযুক্ত থাকার সুবাদে এ দলের প্রার্থীরা উন্নয়নের বার্তাকে ভোট টানার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন। অন্যদিকে একযুগ রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা এবং সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত দল বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে মারাত্মক প্রতিকূল পরিস্থিতি। চেয়ারপারসন কারাগারে থাকায় দলটির নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অগোছালো অবস্থা ঢেকে রাখা যায়নি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন-এমন কথা দলটির নেতারা প্রচার করলেও কর্মকাণ্ডে তার প্রতিফলন দেখা গেছে কমই। বিশেষত প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে এমনসব বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি, যা সমর্থক শুভানুধ্যায়ীদের বিস্মিত করেছে। বেশ কিছু আসনে উপযুক্ত ও জয়ী হওয়ার সম্ভাব্য নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে এমনসব প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, ভোটার দূরের কথা, দলের কর্মীদের কাছেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। এসব ক্ষেত্রে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের জন্য এমন কিছু আসন ছেড়ে দিতে হয়েছে, যেগুলোতে বিএনপি প্রার্থীদের জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। মনোনয়ন নিয়ে এই জটিলতা বিএনপিকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে। উপরন্তু মনোনীত প্রার্থীদের অনেকের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দশটি আসনে ধানের শীষের কোনো প্রার্থী নেই। অভ্যন্তরীণ এসব সমস্যা দলটিকে বেশ নাজুক অবস্থায় রেখেছে।

অপরদিকে নির্বাচনী প্রচারণাও ঠিকমতো চালাতে পারেনি বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা। নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মী ও প্রার্থীরা। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মোহাম্মদ শাহজাহান, কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহা, যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাসসহ বহুসংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রার্থী আক্রমণের শিকার হয়েছেন, বাধাগ্রস্ত হয়েছেন নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে। ফলে বিএনপি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বলে অভিযোগ করে আসছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। বরং নির্বাচনে প্লেয়িং ফিল্ড রয়েছে এবং প্রচারণার ক্ষেত্রে সব দল সমান সুযোগ পাচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। এ নিয়ে সিইসি নূরুল হুদা ও ইসি মাহবুব তালুকদারের মধ্যে যে বাগ্যুদ্ধ হয়ে গেল তা সবারই জানা।

নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশে সেনা মোতায়েনের দাবি অনেক আগে থেকেই জানিয়ে আসছিল বিএনপি। গত ২৪ ডিসেম্বর সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করা হয়েছে। বিএনপি আশা করেছিল সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হবে এবং তাদের প্রার্থীরা নির্ভয়ে প্রচারণা চালাতে পারবেন। কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি পরিস্থিতির উন্নতির আভাস দেয় না। বরং সেনা মোতায়েনের পরও বিএনপি প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর সরকারি দলের অব্যাহত হামলা অনেককেই হতবাক করেছে। এদিকে সেনা মোতায়েনের পরও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান হয়নি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেনা মোতায়েনের খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন তিনি। গত ২৫ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানাতে গিয়ে সিইসি নূরুল হুদার সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে বৈঠক শেষ না করেই উঠে আসেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিইসি আমাদের কোনো কথাই শোনেননি। আমরা সারা দেশে পুলিশের ধরপাকড়, হয়রানির বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছি, তিনি শোনেননি। তিনি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করেছেন।’ অন্যদিকে এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম ‘নির্বাচন কমিশনে টেবিল চাপড়ে ড. কামাল হোসেন মাস্তানি করেছেন’ বলে মন্তব্য করেছেন। 

নির্বাচনকে ঘিরে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের খেলাও বেশ জমে উঠেছে। বিরোধী দল অভিযোগ করছে, সরকার ও নির্বাচন কমিশন সংঘবদ্ধভাবে নির্বাচনে কারচুপির নীল নকশা আঁটছে। তারা এ অভিযোগও করছেন যে, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান ইসি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। গত ২৫ ডিসেম্বর চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ, অকার্যকর-এটা আজ জাতির সামনে প্রমাণ হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট এই মুহূর্তে সিইসির পদত্যাগ দাবি করছে।’ অপরদিকে ‘ভরাডুবি’ নিশ্চিত জেনে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা করছে বলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম গত ২৩ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সহযোগীরা চরম পন্থা বেছে নিতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। গত ২৬ ডিসেম্বরের একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নাশকতার আশঙ্কা করছেন।’ পত্রিকাটি লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে এই বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন, ‘আমার কাছে খবর আছে, বিদেশে পলাতক বিএনপি নেতা তারেক ড. কামালকে ফোন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছে। তাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি এখন নাশকতার’ (দেশ রূপান্তর)।

নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় অনেকেরই রয়েছে। দেশি-বিদেশি সংস্থা ও বিশিষ্টজনরা তাদের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে সরকারসহ সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। গত ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবীসহ ২৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে কি-না, তা নিয়ে জনমনে প্রবল সংশয় ও দ্বিধা কাজ করছে। উৎসবের বদলে আতঙ্ক আর উদ্বেগ ঘিরে রেখেছে মানুষকে।’ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে পাঁচ দফা দাবিও উত্থাপন করা হয়। গত ২২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক মন্ত্রী মার্ক ফিল্ড এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে নির্বাচনী সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল সরকারই পারবে বাংলাদেশকে বৃহত্তর অর্থনৈতিক দেশে রূপান্তর করতে। তিনি বাংলাদেশের সব নাগরিককে সহিংস আচরণ পরিহার করারও আহ্বান জানিয়েছেন। একই দিন জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্তেফান দুজারিকও এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে নির্বাচনী সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে দমনমূলক পরিবেশ বিরাজ করছে। এ ধরনের অবস্থা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।’ সংস্থাটি নির্বাচনে সরকারবিরোধী প্রার্থীদের সুরক্ষারও দাবি জানিয়েছে। নির্বাচন এখন একেবারে দোরগোড়ায়। দেশবাসী একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশায় পাঁচটি বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। তারা ভীতিহীন চিত্তে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। কিন্তু সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সে পরিবেশ কতটুকু আছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অসঙ্গত নয়।

সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো পক্ষের কারণে যদি সে সৌন্দর্যের হানি হয়, তা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার গত ২৬ ডিসেম্বর তার অফিসে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে দেশবাসী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে চারটি সতর্কবার্তা সংবলিত একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি তার সতর্কবার্তায় নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সবাইকে তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কথাগুলো ইসি মাহবুব তালুকদারের নিজস্ব হলেও বাস্তবতার নিরিখে তার গুরুত্বের কথা অস্বীকার করা যাবে না।

দেশবাসী চায় একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশের দায়িত্ব পালনকারী সরকার নির্ধারিত হোক। সর্বোপরি তাদের ভোটাধিকারের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক। তাদের সে চাওয়া কতটা বাস্তব রূপ লাভ করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১