বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০২ December ২০১৮

নির্বাচন নিয়ে নির্বাচিত বিষয়

প্রাচীন রোমের একটি ভোটের দিন সংরক্ষিত ছবি


নির্বাচন অত্যন্ত জটিল সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ধারণা। সমাজ বিকাশের সূত্র ধরেই নির্বাচন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে মানবসভ্যতায়। নির্বাচন মানেই একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। গণতন্ত্র একমুখী- সবক্ষেত্রে এরকম কোনো বিষয় নয়। যদিও সব দেশেই ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন করা হয়; তবু দেশে দেশে ভিন্নতা আছে ভোটদান ও অন্যান্য কিছু বিষয়ের। সারা বিশ্বের মানুষ কীভাবে উদযাপন করে এই নির্বাচনের সময়টি, তারই কিছু সারসংক্ষেপ নিয়ে এই আয়োজনটি তৈরি করেছেন কামরুল আহসান

গোত্রবদ্ধ মানুষের পথচলার জন্য স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন একজন নেতার বা বিশেষ নেতৃত্বের। তা না হলে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। দশজন মানুষের মধ্য থেকে একজনকে বাকিদের সিদ্ধান্তে নেতা হিসেবে গ্রহণ করা হয় নির্বাচন পদ্ধতিতে। তবে নেতা যে সবসময় দশজনের সিদ্ধান্তেই নির্ধারিত হন তাও নয়। অনেক সময় বিশেষ ব্যক্তির শক্তিমত্তা বাধ্য করে তাকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে। যুগে যুগে এও দেখা গেছে, বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ-স্বৈরাচারী শাসকরা জোরজবরদস্তি করেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছেন। তাতে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধবিগ্রহও বেড়েছে। কারণ একজন নিয়মবহির্ভূতভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলে অন্যপক্ষ তাকে হটাতে চেয়েছে। তাই সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আবিষ্কার করেছে উন্নত গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা। বলা হয়, গণতন্ত্রের শুরু প্রাচীন গ্রিসে আড়াই হাজার বছর আগে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তারা বলেন, গ্রিসের আগেই প্রাচীন ব্যাবিলন, মিসর, ভারত ও চৈনিক সভ্যতায় একধরনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সীমিত আকারে গণতন্ত্রের চর্চা হতো। অন্তত রাজা-বাদশাহ-সম্রাটের সভাসদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তবে আধুনিক গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ যে গ্রিসের নগররাষ্ট্র এথেন্স থেকেই, তা নিয়ে তেমন দ্বিমত নেই। আড়াই হাজার বছর আগে এথেন্সে দেখা দিয়েছিল রাজনৈতিক-দর্শনের এক অপূর্ব যুগ। সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলের হাত ধরে গণতন্ত্র একটি সুসংহত রূপ পায়। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এবং অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিকস’ রাষ্ট্রতত্ত্ব ও গণতন্ত্রের সূচনা। রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, নির্বাচন- এগুলো প্রায় একই সঙ্গে গ্রোথিত।

গ্রিসে কেন গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এ নিয়ে আছে মজার এক নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। কারণ গ্রিসে লোহা আবিষ্কার হয়েছিল। লোহা আবিষ্কার হয়েছিল বলে কী হয়েছিল? তাতে কৃষি সরঞ্জাম এবং জাহাজ নির্মাণ সহজ হয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল দ্রুত। আর গ্রিস নগররাষ্ট্রগুলো বিভক্ত ছিল বহু বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য তাদের এক জায়গায় জড়ো হতে হতো। এভাবেই গড়ে ওঠে নগর, নগর না হলে গণতন্ত্র ও নির্বাচন পদ্ধতি হতো বিলম্বে। যেমনটা হয়েছে ভারতবর্ষে। এসব অঞ্চলে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের তেমন যোগাযোগ ছিল না। পাঁচ-দশটি গ্রামের মধ্যেই বেশিরভাগ ব্যবসায়িক কাজ চলত। ফলে এসব অঞ্চলে গড়ে উঠেছে গঞ্জ। আর গ্রামকেন্দ্রিক বিচার-আচার, সালিশ কেন্দ্র, নেতৃত্বের জন্য গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। বাংলাদেশের বিখ্যাত ইতিহাস গবেষক আকবর আলী খান তার ‘বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা’ গ্রন্থে জানিয়েছেন এমনটাই।

সে যা-ই হোক, রাষ্ট্রের উৎপত্তি, গণতন্ত্রের শুরু, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে বহু দার্শনিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক আলাপ। নির্বাচন পদ্ধতি যে কেবল মানুষের মধ্যেই বহাল তাও নয়, অন্যান্য প্রাণিজগতের ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব নির্বাচন পদ্ধতি দেখা যায়। যেমন মৌমাছিরা রানি মৌমাছির নেতৃত্ব মেনে নেয়। এমনটা দেখা যায় অনেক পাখি, প্রাণী ও মাছেদের ক্ষেত্রেও। একটি মাছ, পাখি, হাতির নেতৃত্বেই দলের অন্যরা চলে। নেতৃত্ব মেনে না নিলে আসলে কোনো প্রাণিজগতই টিকতো না। এ নিয়ে অসামান্য এক গল্প আছে সুফি-দার্শনিক ফরিদ উদ্দিন আত্তারের। পাখিদের সম্মেলন। একদিন জগতের সব পাখি ঠিক করল তাদের একজন রাজা দরকার। কে হবে রাজা? হুদহুদ পাখি বলল, চল যাই সিমুর্গের দেশে। সে-ই সবচেয়ে জ্ঞানী, সে-ই নির্বাচন করবে কে হবে আমাদের রাজা। হুদহুদ পাখির নেতৃত্বে জগতের সব পাখি চলল সিমুর্গের দেশে। সে বহু দূরের পথ। সাতটি বিরাট বিরাট পাহাড় পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। একেকটি পাহাড় পার হয় আর একেক দল পাখি যাত্রা থামিয়ে দেয়। তারা ভয় পায়, ক্লান্ত হয়ে যায়। অনেক পাখি মারা পড়ে। সামনে আর আশা দেখে না। হুদহুদ পাখিকে তারা জিজ্ঞেস করে, আর কতদূরের পথ? হুদহুদ পাখি বলে, ওই তো, ওই দেখা যায় আরেক পাহাড়ের ছায়া। আসো, আসো, আরেকটু কষ্ট করে আসো। নিশ্চয়ই এই পাহাড়টা পার হলেই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। আমরা যদি আমাদের রাজাকে খুঁজে না পাই, তাহলে কী অর্থ আছে আমাদের বেঁচে থাকার!

এটা একটা প্রতীকী গল্প। এখানে রাজা মানে আল্লাহ বা ঈশ্বর। একদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছিল কেবল ঈশ্বরের প্রতিনিধিদেরই রাজত্ব। এখনো কোনো কোনো দেশে ঐশ্বরিক গ্রন্থকেই রাষ্ট্রের একমাত্র সংবিধান হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। যেমন সৌদি-ইরানসহ কিছু ইসলামিক দেশে। মধ্যযুগের পর ইউরোপের কিছু দেশ চার্চ বা ঈশ্বরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় ধারণা থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের মতে, ধর্ম যেহেতু বহু আর যুগে যুগে মানুষের সমাজ যেহেতু বদলায়, তাই মানুষের সভ্যতা চলবে মানুষেরই আইনে। ধর্মকে তারা রেখে দেয় রাষ্ট্রবহির্ভূত ব্যক্তিগত চর্চায়। এখনো বহু দেশ রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করে, আবার কেউ কেউ মনে করে ধর্মই একমাত্র রাজনীতি।

সে যা-ই হোক, এও এক বিরাট বিতার্কিক আলাপ। আধুনিক গণতন্ত্রের সূচনা ইউরোপেই, শিল্পযুগের পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ভূমিনির্ভর সমাজব্যবস্থার পর শিল্পনির্ভর সমাজব্যবস্থা শুরু হলে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্র-সমাজ-দর্শনে অনেক পরিবর্তন আসে। নির্বাচন পদ্ধতিটি আসলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। পুঁজিবাদী সমাজ জন্ম দিয়েছে বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। এর মধ্যে গত একশ বছরে পৃথিবী বহুরকম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। গণতান্ত্রিক, আধাগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, আধাসমাজতান্ত্রিক, আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। একেক রাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতিও হয়েছে একেকরকম। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতি একরকম, ইংল্যান্ডের নির্বাচন পদ্ধতি একরকম আবার ইরানের নির্বাচন পদ্ধতি আরেকরকম। সৌদি আরবে এখনো রাজতন্ত্র বহাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, তারা কমবেশি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতিই অনুসরণ করেছে। যত যা-ই হোক, নির্বাচন ছাড়া যে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলতে পারে না, তা প্রমাণিত হয়েছে। একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন সমাজের বহু পথ-মতের লোকের সমন্বয়। আধুনিক সমাজরাষ্ট্র একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, জনগণের প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেওয়ার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতি অনস্বীকার্য। আগামী ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের একদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। নানা কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটি নিয়ে চলছে বিতর্ক। শেষ পর্যন্ত যেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তা-ই জনগণের প্রত্যাশা।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১