বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৮ September ২০১৮

জ্ঞানের বড়াই, জ্ঞানের লড়াই

জ্ঞান এক আরাধ্য বস্তু আর্ট : রাকিব


সালেহ্ মাহমুদ রিয়াদ

সেপ্টেম্বর ২০১৮-এর কুড়ি তারিখের ‘বাংলাদেশের খবর’-এর উপ-সম্পাদকীয়তে ‘জ্ঞানের প্রতিপক্ষ এমসিকিউ’ শীর্ষক নিবন্ধটি আশা করি আমাদের পাঠকরা দেখে থাকবেন। আমরা এমন আশাও করতে পারি যে, পাঠকবৃন্দ রচনাটিকে কথিত এমসিকিউ পদ্ধতিতে পাঠ করেননি; কেননা, আমরা অধুনা জ্ঞানকে ‘কিউ’তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। ‘কিউ’টি কতখানি লম্বা কিংবা আঁকাবাঁকা— সেটি বড় প্রশ্ন নয়, মূল বক্তব্যটি হলো (নিবন্ধকারের ধারণার সঙ্গে সহমতে) এমসিকিউ দিয়ে জ্ঞানলাভ সম্ভব কি না। আমরা প্রকাশিত রচনা সম্পর্কে কোনো মতামত, সিদ্ধান্ত, উপসংহার ইত্যাদি ঘোষণা না করে জ্ঞানলাভ বিষয়ে পদ্ধতিসমূহের পুনর্বিবেচনা করতে আগ্রহী।

বহুকাল থেকেই জ্ঞান অর্জনের উপায় হিসেবে গ্রন্থ পাঠ একটি অন্যতম পদ্ধতি রূপে চালু রয়েছে। বইপুস্তক ছাপানোর আগেও স্মৃতি আর শ্রুতি পদ্ধতিতে জ্ঞানের চর্চা হয়েছে এ পৃথিবীতে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে। ভারতে গুরুগৃহে বাস করে গুরুর নিকট শুনে শুনে মুখস্থ করা ছাড়া বিদ্যাধারণের আর কোনো উপায় ছিল না। এ ব্যবস্থা ছিল কেবল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের জন্য। অন্যদের জন্য বলতে গেলে তেমন কোনো আয়োজনই ছিল না।

দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরেও জ্ঞানলাভের চেষ্টা করা হয়েছে। শুধু বিদ্যা অর্জন করার জন্য কতই না ক্লেশ স্বীকার করতে হতো। অনাহারে অর্ধাহারে অচেনা অজানা কোনো এক অচিন সভ্যতার দুয়ারে গিয়ে জ্ঞানের সন্ধান করা— আজকের দিনের গুগল ই-মেইল ইয়াহু জামানায় কল্পনা করাও কঠিন। জ্ঞানলাভের জন্য সুদূর চীন যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন নবীজী। অর্থাৎ জ্ঞান মাত্রেই এক সুকঠিন অধ্যবসায় ও সাধনার বিষয় ছিল। ‘ছিল’ বলার অর্থ এই নয় যে, এখন জ্ঞানার্জন অতিসহজ হয়ে গেছে। জ্ঞানের পথ কখনো খুব সহজ নয়।

গ্রন্থ রচনার সেই আদি যুগে হাতে কপি করা বই একখানা-দুখানা করে লেখা হতো। ওইসব দুর্লভতম গ্রন্থের মালিক জীবন দিয়ে হলেও হাতছাড়া করতেন না তার অমূল্য গ্রন্থখানি। জ্ঞানের মূল্য কী বিশাল! কথিত আছে একদা একজন হেকিমের মহামূল্যবান গ্রন্থখানি সুলতান বাহাদুর চেয়ে পাঠালে হেকিম সাহেব পড়লেন মহাবিপদে। বইখানি তিনি হাতছাড়া করতে চান না; আবার বই না দিলেও হেকিমের মাথাখানি হাতছাড়া হয়ে যাবে। বিপুল গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রাণঘাতী বিষ মাখিয়ে হেকিম পাঠিয়ে ছিলেন সুলতানের কাছে। গ্রন্থপ্রেমিক সুলতান আহার নিদ্রা ভুলে পাঠ করছেন গ্রন্থ। জিহ্বায় আঙুল ভিজিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছেন আর প্রতিটি পৃষ্ঠায় মাখানো তীব্র বিষ সুলতানের অজান্তেই সুলতান পান করে চলেছেন। গ্রন্থের শেষ পৃষ্ঠা উল্টাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন গ্রন্থ প্রেমিক সুলতান।

হয়তবা এটি একটি গল্পমাত্র, তবে এই গল্পের মধ্যেই নিহিত রয়েছে জ্ঞানতৃষ্ণার প্রতি এক তীব্র বাসনার কথা। জ্ঞান এক আরাধ্য বস্তু। আমরা পরম ভাগ্যবান এই জন্য যে, এখন আর আমাদের বই ধার করে এনে পড়তে হয় না অথবা পড়তে পড়তে মৃত্যুর সম্ভাবনাও নেই। বই পড়ে কেউ উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করলে সেটি অবশ্য আলাদা কথা। বাস্তবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।

কাগজ আবিষ্কারের পর কোটি কোটি বই ছাপা হচ্ছে। জগতের প্রায় সব জ্ঞান কাগজের পাতায় পাতায় বর্ণে বর্ণে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। হেন কোনো বিদ্যা নেই, যা আপনি কাগজ আকারে পাবেন না। মহাবিশ্বে ভাসমান প্রায়-অদৃশ্য প্রতিকণা অণুগঠনের বিস্তারিত বিবরণ থেকে শুরু করে কাঠের বিছানায় শয়ন পদ্ধতি বিষয়ের যাবতীয় জ্ঞান বইপুস্তকে সহজলভ্য। বই কেনার সামর্থ্য না থাকলেও আপনার বিদ্যালাভে কোনো বাধা নেই। গণগ্রন্থাগারে গিয়ে আপনি অভিলাষিত বিদ্যালাভ করতে পারবেন। আজকাল অবশ্য গণের ব্যাপক বিকাশ ঘটলেও গ্রন্থাগারগুলো বিরল প্রজাতির ন্যায় নিখোঁজ হয়ে গেছে।

জ্ঞান তো আর এলোমেলোভাবে অর্জন করা যায় না; সুতরাং, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে কী কী বিষয়ে কীভাবে পড়া হবে—তার বিস্তারিত আয়োজন করা হলো। গড়ে উঠল প্রথাগত প্রণালিবদ্ধ শিক্ষা পদ্ধতি। আমরা সবাই এই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার নিকট বিদ্যালাভের জন্য ঋণী। প্রকৃতপ্রস্তাবে, আমাদের জ্ঞানজগতের একটি অন্যতম প্রধান উপায় হয়ে উঠল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেড়শ’-দুইশ’ বছর ধরে আমরা এই নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে বিদ্যালাভ করেছি। প্রকৃতপক্ষে, ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষানীতির কাঠামোর মধ্যেই ভারতবর্ষের শিক্ষা কর্মসূচি চলে এসেছে। জ্ঞানজগতে এ-রকম পদ্ধতি নিয়ে আমরা সাফল্য দেখিয়েছি বহুক্ষেত্রে। বাংলা একদা সারা ভারতের সম্মুখভাবে দাঁড়িয়ে সমগ্র উপমহাদেশকে প্রবুদ্ধ করেছিল ওই সনাতন শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়েই। এ কথার অর্থ এই নয় যে, প্রচলিত শিক্ষা কাঠামো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছিল। আমাদের শিক্ষানীতি কী হওয়া উচিত— এই নিয়ে আমরা আজো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। অথচ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে ড. কুদরত-ই-খুদা একটি অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সম্পূর্ণরূপে কখনো নীতিটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।

একটিমাত্র উদাহরণ দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ‘উজ্জ্বলচিত্র’ প্রকট করতে চেয়েছি। আমরা অনেকেই পিতা বা জ্যেষ্ঠভ্রাতার অতিক্রান্তগ্রন্থের শ্রেণিপাঠক হয়েছি; বয়ে চলেছি এক অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাধারা। বইগুলো পুরাতন হয়ে যেত বলে মনটা একটু অবশ্য খারাপ হতো, কিন্তু বিদ্যা প্রাচীন বা বাতিল হয়ে যেত না। প্রতিবছর বিভিন্ন শ্রেণির গ্রন্থ ও পাঠ্যক্রম পাল্টে ফেলার ভেতর কি তবে লুকিয়ে আছে পুস্তক ব্যবসায়ী, প্রকাশক, পরিবেশক ও লেখকসহ কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর এক কুয়াশাপূর্ণ অশুভস্বার্থ?

সবকিছু ছাপিয়ে আবির্ভূত হয়েছে আরেক বিস্ময়কর পদ্ধতি। মার্কিনমুল্লুক থেকে এসেছেন— এমসিকিউ। মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন (সম্ভবত বর্ণবিস্তার করলে এমনই হওয়ার কথা)। এর কোনো বাংলা অনুবাদ নেই, এর কোনো বঙ্গানুবাদ হয় না। বেশ কয়েক বছর শিক্ষাক্ষেত্রে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। মূলগ্রন্থ পাঠের কোনো আবশ্যকতা নেই, বিষয়বস্তু জানার কোনো প্রয়োজন নেই, কেবল একটা টিকমারা শিখতে হবে। যথস্থানে টিক পড়লেই বিদ্যালাভের কর্তব্য ও শ্রম— দুটোই যথাসম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। কয়েক হাজার প্রশ্ন এবং প্রতি প্রশ্নের নিচে গণ্ডাখানেক উত্তর লিখে রাখাই হচ্ছে এই বিদ্যা-পদ্ধতির একমাত্র কৌশল। এই টিকবিদ্যার একটি প্রখ্যাত উদাহরণ দেওয়ার লোভ কোনোভাবেই দমন করা গেল না। প্রশ্ন : ‘শেষের কবিতা’ কী ধরনের কবিতা? উত্তর : ক. ভালোবাসার কবিতা, খ. দ্রোহের কবিতা, গ. রোমান্টিক কবিতা, ঘ. বিরহের কবিতা। পাঠক বুঝতেই পারছেন প্রশ্নকর্তা নিজেই জানেন না, এটি কোনো কবিতাই নয়।

এমসিকিউ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কী ‘অবদান’ রেখে চলেছে— তার একটি প্র্যাকটিক্যাল নমুনা দিয়ে এ-রচনা শেষ করব। চাকরির সাক্ষাৎকারে জনৈক প্রার্থীকে পিতার নাম জিজ্ঞাসা করা হলো। প্রার্থী বললেন, ‘স্যার অন্তত চারটি নাম লিখুন।’ প্রশ্নকর্তা : ‘কেন, চারটি নাম কেন?’ প্রার্থী : ‘যে কোনো একটিতে টিক দিতে হবে তো।’

লেখক : রম্য লেখক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১