আপডেট : ২৫ September ২০১৮
বেহুলার পাটা ও মনসা মুড়া উপমহাদেশে বেহুলা-লখিন্দরের ঘটনা শোনেনি এমন লোকের খোঁজ মেলা ভার। কিন্তু বেহুলা-লখিন্দরের পাটা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। এ শিলাটির একটি খণ্ডাংশ বক্তারখাঁর শাহী মসজিদের পশ্চিম পাশে সম্পূর্ণ অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে আছে। কচুয়া উপজেলার উজানী গ্রামে রাজবাড়ীর দক্ষিণাংশে রয়েছে স্বনামে পরিচিত বেহুলার দীঘি। বেহুলার দীঘির উত্তর পাড়ে রাজবাড়ী হতে প্রায় ৫০ মি. দক্ষিণে বেহুলার ছোটবেলার খেলনার সামগ্রী পুরনো পাথরের নির্মিত শিলাটি (আঞ্চলিক ভাষায় বেহুলার পাটা) আংশিক বিদ্যমান আছে। দৈর্ঘ্য ৩২ ইঞ্চি ও প্রস্থ ২৬ ইঞ্চি এ শিলাটির ওজন প্রায় ২৫০ কেজি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ শিলাটি আদি অবস্থার আংশিক মাত্র। কয়েক বছর পূর্বে জনৈক ধোপা এই শিলায় খারাপ কাপড় ধোয়ার সময় শিলাটি বিকট শব্দে স্থানান্তরিত হয়ে উজানী গ্রামের দুধখাঁর দীঘিতে পতিত হয়। শিলা পাটাটি পানির ওপর ভেসে ওঠে বলে জনশ্রুতি আছে। লোকমুখে আরো শোনা যায়, এ উজানীতে মাটির নিচে বেহলা-লখিন্দরের লোহার বাসর ঘর রয়েছে। জানা যায়, কচুয়ার মনসা মুড়া নামক বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে কলাগাছ দিয়ে ভেলা তৈরি করে, সেই ভেলায় ভেসে মনসা মুড়ার সম্মুখ থেকে বয়ে যাওয়া ধনাগোদা ধনী দিয়ে লখিন্দরের মরদেহ নিয়ে দেবপুরীতে রওনা দেয় বেহুলা সুন্দরী। জনশ্রুতি রয়েছে, মনসা মুড়া থেকে বাঁশ কেটে কলার ভেলা বানানোর কারণে মনসা মুড়ায় সাপেরা বাসা বেঁধেছে, যেন এখান থেকে আর কেউ বাঁশ কাটতে না পারে। কেউ কেউ বলেন, কলার ভেলায় ব্যবহূত বাঁশের কঞ্চি থেকেই এই বাঁশ মুড়ার সৃষ্টি হয়েছে, তাই এখানে সর্প দেবী মনসার নির্দেশে ভয়ানক সব সাপ বাসা বেঁধেছে। এখানকার বটতলায় বছরে একবার মনসা দেবীর পূজা হয়ে থাকে। হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার অন্যতম প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ। এটি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন আহমাদ আলী পাটওয়ারী ওয়াক্ফ এস্টেটের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। কালের বিবর্তনে মসজিদটি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। এই মসজিদে এসেছেন অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব মোশারফ হোসেন, নবাবজাদা নসরুল, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.), আল্লামা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.), আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী (রহ.), আল্লামা আতহার আলী (রহ.), আল্লামা এহতেশামুল হক থানবী (রহ.) সহ আরো অনেকে। বাংলা ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে মনাই হাজী (রহ.)-এর দৌহিত্র আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) বর্তমান বড় মসজিদের মেহরাব বা তৎসংলগ্ন স্থানজুড়ে প্রথমে একচালা খড়ের ইবাদতখানা থেকে দোচালা খড়ের মসজিদ, অতঃপর টিনের দোচালা মসজিদ থেকে ওই পাকা মসজিদ স্থাপন করেন। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশ্বিন হজরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.) পাকা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। দুই হাজার বর্গহাত আয়তনের মসজিদটিতে মর্মর পাথর বসানোসহ মূল মসজিদের প্রথম অংশের ভবন নির্মিত হয়। মসজিদের মেহরাবটি নিপুণভাবে কাঁচের টুকরো কেটে মনোরম ফুল-ঝাড়, নকশা-নমুনায় অপরূপ সাজে নিখুঁতভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। রাতে মসজিদের ভেতরের যখন সব বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তখন বিচ্ছুরিত আলোর আভায় জ্বলজ্বল করে মেহরাবটি। মসজিদের প্রথম অংশের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ১০ অগ্রহায়ণ ওই পাকা মসজিদ থেকে জুমার নামাজের আজান দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক সেই জুমার নামাজের জামাতে ইমামতি করেন পীরে কামেল আলহাজ হজরত মাওলানা আবুল বাশার জৈনপুরী (রহ.)। মসজিদটিতে রয়েছে বিশাল আকৃতির তিনটি গম্বুজ। মেহরাব বরাবর মসজিদের পূর্বপ্রান্তের সর্বশেষ প্রাচীরে রয়েছে নানা রঙের কাচের টুকরো দিয়ে পবিত্র কলেমা খচিত সুদৃশ্য নকশা দিয়ো নির্মিত রাজকীয় কায়দার ঐতিহ্যবাহী বিশাল ফটক। মসজিদের সামনেই রয়েছে বিশাল চত্বর। জমিদার রূপসা মিঞার স্মৃতি ফরিদগঞ্জের ডাকাতিয়াবিধৌত ফরিদগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত একটি জনপদের নাম রূপসা। আজো উপজেলার সমৃদ্ধিশালী এই অঞ্চলটির গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একসময়ের মেঘনার উত্তরপারের ঐতিহ্যবাহী জমিদার চৌধুরী বাড়ি (যারা মিঞা নামে অধিক পরিচিত) পরিবারের ইতিহাস। প্রজাবৎসল হিসেবে এই অঞ্চলের জমিদারদের সুনাম মেঘনার দুই পারেই ছড়িয়ে যায়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক জমিদারই পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করলেও রূপসা মিঞারা ছিলেন এর বিপরীত। ফলে এই অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা অনায়াসেই শক্ত ঘাঁটি গাড়তে পেরেছিলেন। তারা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, জনহিতকর কাজের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। রূপসা বাজারের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে নজর করলেই দৃষ্টিতে পড়বে জমিদার বাড়ির সিংহদ্বার। পাশেই সুশোভিত কারুকাজে একটি মসজিদ। মসজিদের দক্ষিণ পাশেই নামফলকে রচিত কবরস্থান। এর প্রতিটি ফলকে লেখা রয়েছে চিরনিদ্রায় শায়িত ব্যক্তিবর্গের নানা কীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। পথ ধরে সামনে এগোলেই চোখে পড়বে শান বাঁধানো ঘাটসহ দীঘি। এর সামনেই নজরে পড়বে ঐতিহ্যমণ্ডিত কাছারি ভবন। প্রায় আড়াই শত বছর আগের কথা। রূপসার পূর্বে খাজুরিয়া এলাকায় (সিংহেরগাঁও নামে পরিচিত) বাইশ সিংহ পরিবার নামে এক সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য হিন্দু পরিবার ছিল। কালের আবর্তে তাদের জমিদারির বিলুপ্তি ঘটলে আহম্মেদ রাজা চৌধুরীর কৃতিত্ব ও অদম্য স্পৃহায় রূপসা জমিদার বাড়িতে জমিদারির বীজ অঙ্কুরিত হয়। তিনিই ছিলেন এই জমিদারি এস্টেটের কর্ণধার। তার পরেই এই এস্টেট পরিচালনার গুরুদায়িত্ব বর্তায় মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন এই বংশের সর্বাপেক্ষা দানশীল ব্যক্তি। তার মৃত্যুর পর জমিদারি হাতে নেন আহম্মদ গাজী চৌধুরী। প্রকৃত অর্থে মোহাম্মদ গাজীর সুযোগ্য পুত্র আহমেদ গাজী চৌধুরীর সময়কালেই এ জমিদার পরিবারের বিস্তৃতি ঘটে। দয়া ও দানশীলতাই ছিল জমিদার আহমেদ গাজীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি অনেক জমি ওয়াক্ফ করে যান। তার মধ্যে লাউতলী দীঘির ওয়াক্ফ উল্লেখযোগ্য। শিক্ষানুরাগী এই জমিদার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তন্মধ্যে রূপসা আহম্মদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, রূপসা আহম্মদিয়া সিনিয়র মাদরাসা উল্লেখযোগ্য। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার কল্পে তিনি অকৃপণভাবে অনুদান প্রদান করতেন। রূপসার সুপ্রাচীন মসজিদ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও অনেক মসজিদ তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে আজো বসবাস করছে তাদের পাইক পেয়াদাসহ প্রায় ৫০টি পরিবার। আবার অনেকে আশপাশে জায়গা কিনে বসতবাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ী বসবাস করছেন। সময় চলে গেলেও পাল্টেনি রূপসা জমিদারদের বাড়ির শান শওকত এবং কমেনি রূপসা বাজারের ঐতিহ্য। লোহাগড়ের মঠ ফরিদগঞ্জ উপজেলার চান্দ্রা বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে লোহাগড় গ্রামের মঠটি কালের সাক্ষী হিসেবে আজো দণ্ডায়মান। পরম প্রতাপশালী জমিদার পরিবারের দুই ভাই ‘লোহা’ ও ‘গহড়’। তারা এতই প্রভাবশালী ছিলেন যে, যখন যা ইচ্ছে তা-ই করতেন এবং তা প্রতিফলিত করে আনন্দ অনুভব করতেন। এই দুই ভাইয়ের নাম অনুসারে গ্রামের নাম ‘লোহাগড়’ রাখা হয়। জনৈক ব্রিটিশ পরিব্রাজক লোহাগড় গ্রাম পরিদর্শনে গেলে তাদের ঐতিহ্য দেখে মুগ্ধ হন। কথিত আছে, ওই পরিব্রাজকের জন্য নদীর কূল থেকে তাদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা, যার প্রস্থ ২ হাত ও উচ্চতা ১ হাত, দৈর্ঘ্য ২০০ কিলোমিটার রাস্তা সিকি ও আধুলি মুদ্রা দিয়া নির্মাণ করেন। সাধারণ মানুষ তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ভয়ে চলাফেরা করত না। তবে তারা ছিল অত্যাচারী জমিদার। লোকমুখে শোনা যায় তাদের অত্যাচারের কাহিনী। ডাকাতিয়া নদীতে নৌকাযোগে এক প্রসূতি মহিলা যাচ্ছিলেন। দুই ভাই তা দেখে মন্তব্য করলেন প্রসূতি মহিলার গর্ভে ছেলে, না মেয়েসন্তান। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে তর্কের একপর্যায়ে ওই মহিলাকে ধরে এনে পেট কেটে তা প্রমাণ করেন গর্ভে ছেলে না মেয়ে। জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে নৌকাগুলোকে নিঃশব্দে যাতায়াত করতে হতো। ডাকাতিয়া নদীর কূলে তাদের বাড়ির অবস্থানের নির্দেশিকাস্বরূপ তারা সুউচ্চ মঠটি নির্মাণ করেন। আর্থিক প্রতিপত্তির নিদর্শন হিসেবে তারা মঠের চূড়ায় একটি স্বর্ণের দণ্ড স্থাপন করেন। এই স্বর্ণদণ্ডের লোভে মঠের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করে কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন বলেও শোনা যায়। এই বৃহৎ স্বর্ণদণ্ডটি পরবর্তীকালে ঝড়-তুফানে মঠচূড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীতে পড়ে পড়ে যায়। ওই নদীতটের জমিতে চাষ করার সময় এক কৃষক সেই স্বর্ণদণ্ডটি পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। লোকমুখে আরো শোনা যায়, দণ্ডটির ওজন প্রায় আড়াই মণ ছিল। লোহাগড়ে এই দুই ভাইয়ের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়েছে। এখনো মাটির নিচে গহ্বর রয়েছে এবং মঠটি দাঁড়িয়ে আছে দুই ভাইয়ের দোর্দণ্ড প্রতাপের নীরব সাক্ষী হয়ে। সাহেবগঞ্জের ‘নীলকুঠি’ ফরিদগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক সাহেবগঞ্জ গ্রামে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ বণিকরা নীলচাষের খামার হিসেবে একটি ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। গ্রামটির নকশা এবং রাস্তাঘাট, পানি নিষ্কাশনের খাল, পাকা কালভার্ট, বারোটি স্থানের পুরনো দালানকোঠা ও জেল-হাজতখানার বিভিন্ন নমুনা সেটাই প্রমাণ করে। জানা যায়, এটি একটি শিল্প ও বাণিজ্য এলাকা ছিল। বর্তমানে এ এলাকার বাসিন্দা কিছু খলিফা নামধারী দর্জিকে ফিরিঙ্গি বণিকরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এনে ঢিলেঢালা পোশাক তৈরি করে বিভিন্ন রঙে সাজিয়ে বিদেশে চালান দিত। নীলচাষে অনিচ্ছুক চাষিদের শাস্তি ও ভয় দেখানোর জন্য ফিরিঙ্গিরা জেলহাজতের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন থেকে ওইসব বিদেশি দর্জি এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। প্রচলিত রয়েছে, একসময় ফিরিঙ্গি বণিকরা চলে যাওয়ার পর কয়েকশ বছর ওই গ্রামে হোগলা পাতা ছাড়া অন্য কোনো ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা ছিল না। এ জন্য এই গ্রামটির আগের নাম ‘চারপাতা’ ছিল। এমনকি শতাধিক বছর ধরে নীলকুঠিতে জঙ্গল সৃষ্টির ফলে বাঘ-ভাল্লুকের আস্তায় পরিণত হয়। তখন ইলিয়ট সাহেব বেতনধারী বহু বন্য পশু শিকারি এনে প্রজা ও স্বজাতি খ্রিস্টান পরিবার রক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। অবশেষে তিনি এই গ্রামটিকে ‘সাহেবগঞ্জ’ নামকরণ করেছেন। এ গ্রামেই বর্তমান হাইস্কুলের পাশে ইংরেজ সাহেবদের নির্মাণ করা প্রায় বিলুপ্তির পথে ঐতিহাসিক ‘নীলকুঠি’ অবস্থিত।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১