আপডেট : ২৯ July ২০১৮
দুদিন হলো অফিসে যাচ্ছে না নাওয়ার (ছদ্মনাম)। পরিবারের কেউ কারণ জিজ্ঞেস করলে শরীর খারাপের অজুহাত দিচ্ছে। কারো সঙ্গে তেমন কথাও বলছে না। দুদিন আগেই অফিসে এক অপ্রীতিকর ঘটনায় সে মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছে। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজের সুবাদে বেশ হাই প্রোফাইল ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হতো তার। সেদিন এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিংয়ের সময় লোকটি তাকে নানা ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলার এক পর্যায়ে গায়েও হাত দেয়। নিজের অফিসে এমন একটি ঘটনার শিকার হয়ে সে মানসিকভাবে একদমই ভেঙে পড়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে চাকরিটি ছেড়ে দেওয়ার। নাওয়ারের মতো কর্মক্ষেত্রে নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয় নারীকর্মীদের প্রতিনিয়ত। কখনো শারীরিক কখনো বা মানসিক। নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের পরিসংখ্যানটা দিন দিন বাড়ছে। যোগ্যতায় নিজেকে বার বার প্রমাণ দিয়ে নারী আজ পুরুষের পাশাপাশি উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও শুধু কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টিতেই নারী এখনো দুর্বল। আর এ জায়গাটিতে নারীর নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে দিন দিন। মানসিক ও যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বেশ ক’জন কর্মজীবী নারীর কাছে জানতে চাওয়া হয় কর্মক্ষেত্রে সাধারণত কী ধরনের হয়রানির শিকার হন তারা। তাদের বক্তব্যেই উঠে আসে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের বিভিন্ন দিক। প্রায় প্রতিটি নারীই কোনো না কোনো সময় কর্মক্ষেত্রে অকারণে শরীর স্পর্শ, কথা বলার সময় অশালীন শব্দ উচ্চারণ, শারীরিক গঠন বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে মন্তব্য, পোশাক নিয়ে অপ্রীতিকর মন্তব্য, ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা ইত্যাদির মুখোমুখি হন। পোশাক শিল্পে নারীদের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের সংখ্যা অন্যান্য জায়গার তুলনায় বেশি। অস্ট্রেলিয়ান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের আর্থিক সহযোগিতায় ‘কর্মজীবী নারী’ নামে একটি সংগঠন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কেয়ারের সহায়তায় বিভিন্ন পোশাক কারখানার ১৫০ নারী শ্রমিকের মধ্যে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ‘এস্টেট অব রাইটস ইমপ্লিমেন্টেশন অব ওম্যান রেডিমেড গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স’ শিরোনামের এ গবেষণা প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে আসে তা অনেকটা এ রকম- বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের প্রায় ১৩ ভাগ যৌন হয়রানির শিকার। শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২০ ভাগ। মানসিক নির্যাতনের শিকার ৭১ ভাগেরও বেশি। আর তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন সুপারভাইজরের হাতে। গার্মেন্ট শিল্পে যেসব নারী কাজ করে তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত শ্রেণির। এই কাজ করে যে পারিশ্রমিক তারা পান, তাই দিয়ে কোনোরকম সংসার চালান। এজন্য চাইলেই চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন না। নানা রকম অপ্রীতিকর আচরণ সহ্য করেও তারা টিকে থাকার চেষ্টা করেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে নারীদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে দিন দিন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও বলেছে, নারীর প্রতি লিঙ্গ বৈষম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে কর্মস্থলে যৌন হয়রানি। তাদের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ নারী কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে কর্মস্থলে যৌন হয়রানি, ইভটিজিং ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ নারী। ইউরোপের ১১টি দেশে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, কর্মস্থলে ৩০ থেকে ৫০ ভাগ নারী দুর্ব্যবহারের শিকার হন, অথচ পুরুষের ক্ষেত্রে এর সংখ্যা মাত্র শতকরা মাত্র ১০ জন। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রিয়ার শতকরা ৮১ ভাগ নারী কর্মস্থলে নির্যাতনের শিকার হন। এর বিপরীতে রয়েছে সুইডেনের অবস্থান। দেশটিতে কর্মস্থলে নির্যাতনের সম্মুখীন হন শতকরা মাত্র দুই ভাগ নারী। ব্রিটেনে এই হার শতকরা ৫৪ ভাগ এবং আমেরিকায় ৪৪ ভাগ। এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই চিত্র কেমন তার দিকে। বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে ২৯ জন নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১২ সালে এ সংখ্যাটি ছিল ২৫ জন, ২০১১ সালে ২৮৭ জন, ২০১০ সালে ৩৭ জন এবং ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ১৩৭ জন। এই পরিসংখ্যান যে চলতি বছরে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে নারীর এ হয়রানির বিষয়গুলো খুব বেশি প্রকাশ পায় না। আর এ বিষয়গুলো গোপন করার কারণ হিসেবে বলা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীদের মনে সংকোচ, চাকরি হারানোর ভয়, মানসম্মানের ভয়, পরিবারটির সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয় কাজ করে। কর্মক্ষেত্রে কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষের জন্য নারী তার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে না। আর কখনো প্রাপ্য স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পুরুষ সহকর্মীটির নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। বলছিলেন একটি এনজিওতে কর্মরত শামীমা আশরাফ। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্ট কর্তৃক নীতিমালা প্রণীত হয় যে, কর্মক্ষেত্রে স্ব স্ব নিয়োগকর্তার তত্ত্বাবধানে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে হবে, যার বেশিরভাগ সদস্য হবে নারী। কোনো রকম আপত্তিকর ঘটনা ঘটার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটির কাছে অভিযোগ পেশ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো অনেক প্রতিষ্ঠানই এখনো এই নীতিমালা সমন্বিত করেনি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে এখনো বেশ উদাসীন। তাই কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি নারীকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনাগুলো গোপন না রেখে অপরাধীকে প্রশ্রয় না দিয়ে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া অফিসে যে ক’জন নারীকর্মী রয়েছেন তারাও নিজেদের মধ্যে জোট গড়ে তুলতে পারেন।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১