আপডেট : ০২ July ২০১৮
জৈব জ্বালানি সম্পর্কে সর্বসাধারণের ধারণা তেমন একটা নেই। জৈব জ্বালানি বা ‘বায়োফুয়েল’ হচ্ছে এক ধরনের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকটি চিন্তা করে জৈব জ্বালানি সম্প্রসারণের সুপারিশ করেছেন পরিবেশবিদরা। জৈব জ্বালানি ইথানল ও ডিজেলের সমন্বয়ে তৈরি নতুন ধরনের জ্বালানি। যার উপাদান হচ্ছে চাল, ডাল, গম, ভুট্টা ও তেলবীজ জাতীয় খাদ্যশস্য। এসব খাদ্যশস্যকে বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে জৈব জ্বালানি প্রস্তুত করা হয়। এর ভালো-মন্দ দুটি দিকই রয়েছে। তবে সার্বিক বিবেচনায় পরিলক্ষিত হচ্ছে জৈব জ্বালানির ব্যবহার হিতের চেয়ে ক্ষতিই বেশি বয়ে আনছে। এটি বর্তমানে শুধু উন্নত বিশ্বেই ব্যবহূত হচ্ছে। অপরদিকে তাদের অনুসরণ করছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। তারা তাদের দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ পামবীজ দিয়ে জৈব জ্বালানি প্রস্তুত করছে। এ ছাড়া দারিদ্র্যের অজুহাতে তৃতীয় বিশ্বের অন্য কোনো দেশ এখনো জৈব জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ নেয়নি। তা ছাড়া এ জ্বালানি প্রস্তুত করা সহজসাধ্য নয়। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। ফলে জৈব জ্বালানি পরিচিতি পেয়েছে ‘উন্নত বিশ্বের জ্বালানি’ নামে। দেখা যাচ্ছে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিল্পোন্নত দেশগুলো দরিদ্র দেশের মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে যানবাহনের ট্যাঙ্কে তুলে দিচ্ছে। যাকে চরম মানবতাবিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এ জ্বালানি প্রস্তুত করতে প্রয়োজন অধিক খাদ্যশস্যের, যা ব্যবহার হচ্ছে ডিজেল ও গ্যাসোলিনের পরিবর্তে। এতে করে কোনো ধরনের বায়ুদূষণ ঘটছে না সত্য এবং এও সত্য যে, জৈব জ্বালানি আবিষ্কার মানবজাতির জন্য সুখবর বটে। কিন্তু সে সুখবরটির আড়ালে রয়েছে মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক, যার শিকার বিশ্বের নিম্ন আয়ের ৮২টি দেশ। এক সমীক্ষায় জানা যায়, শিল্পোন্নত দেশের এ অমানবিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্বে চরমভাবে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার ফলে দাম বেড়ে গেছে যাবতীয় খাদ্যসামগ্রীরও। এর সঙ্গে বেড়ে গেছে ভোজ্য তেলের দামও। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, জৈব জ্বালানির উপকরণ থেকে রেহাই পায়নি সয়াবিন, সরিষা, তিল, তিশি ও পামবীজসহ নানা ধরনের তেলবীজ। অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে ২৫ গ্যালন জৈব জ্বালানি উৎপাদনে যে পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী ব্যবহূত হচ্ছে, তা আফ্রিকার একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের এক বছরের আহার। তার চেয়েও বেশি অবাক করা তথ্যটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরে প্রায় ১০ কোটি টন খাদ্যশস্য প্রক্রিয়াজাত করে জৈব জ্বালানি উৎপাদন করছে। এতে যে পরিমাণ খাদ্যসামগ্রীর ব্যবহার হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের মতো চারটি দেশের মানুষের তিন বছরের খাদ্য বিনষ্ট হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, ২০১৮ সালের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র একাই জৈব জ্বালানি উৎপাদন ১২ গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নও গম দিয়ে জৈব জ্বালানি উৎপাদনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। অপরদিকে ব্রিটেন জৈব জ্বালানি তৈরির জন্য ইতোমধ্যে ১১৩ বিলিয়ন টন ভুট্টার ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। ব্রিটেন অবশ্য অনেক আগে থেকেই জৈব জ্বালানি তৈরি করতে বার্ষিক ৫০ কোটি পাউন্ড ভর্তুকি দিয়ে আসছে। তা ছাড়া জৈব জ্বালানি প্রস্তুতের কারণে অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য প্রচুর বনভূমি ও জলাশয় উজাড়ের প্রয়োজন দেখা দেবে। ইতোমধ্যে উন্নত দেশগুলো কাজটি করছেও। ফলে খনিজ তেল ব্যবহারের দূষণ থেকেও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র বিশ্বের পরিবেশ। বিষয়টি নিয়ে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে ‘দ্য সায়েন্স’ পত্রিকা। সামান্য উদাহরণ টানলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘অ্যাকশন এইড’-এর জরিপ মতে, ইউরোপের ওই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অন্তত ৬৯ হাজার বর্গকিলোমিটার জমিকে শস্য ক্ষেতে রূপান্তরিত করতে হবে- যা কিনা বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসের আয়তনের চেয়ে বেশি। বর্তমানে বিশ্বে উৎপাদিত ৪০ বিলিয়ন লিটার ইথানলের শতকরা ৯০ ভাগই প্রস্তুত করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল। বাদবাকি উৎপাদন করছে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে ৫১ মিলিয়ন টন। অথচ ওই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই ইথানল তৈরিতে ব্যবহার করেছে ৫০ মিলিয়ন টন ভুট্টা। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮ কোটি শিশুর আগমন ঘটছে। সে সূত্রে বলা যায়, ৮ কোটি মানুষ পর্যায়ক্রমে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে খাদ্যশস্যের ওপর ভাগও বসাচ্ছে। হিসাব মতে, জৈব জ্বালানি উৎপাদন এবং নতুন মুখের আবির্ভাবের ফলে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বিশ্বে বছরে প্রায় ১০ কোটি টনে গিয়ে ঠেকবে। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে নিশ্চিত। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের অধিক জ্বালানি চাহিদার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। সেই নির্ভরশীলতা কমাতে এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও পরিবেশ দূষণের বিষয়টি মাথায় এনে তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে বেছে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে জৈব জ্বালানি প্রস্তুতের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার ৪০ লাখ বর্গকিলোমিটার জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উৎপাদনের পুরোটাই তারা জৈব জ্বালানি বা বায়োফুয়েল তৈরিতে ব্যবহার করবে। এর প্রেক্ষিতে বলতে হয়, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে ঠিকই কিন্তু তার আগে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে বিশ্বের অনাহারী মানুষের পেটের আহার জোগানো। যে মানুষের কল্যাণে জৈব জ্বালনির সম্প্রসারণ, পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় মনোযোগী হওয়া; সে মানুষই যদি না খেয়ে দিন যাপন করে, তাহলে ওই আবিষ্কার মানবকল্যাণের পরিপন্থি। আমরা আশাবাদী, বিশ্বের কর্তাব্যক্তিরা এ দিকটি ভেবে দেখবেন আগে। না খেয়ে থাকা মানুষের যন্ত্রণা অনুভব করবেন তারা। এসব ঠিকঠাক থাকলে অথবা এর সঠিক সমাধান হলে এ আবিষ্কার সার্থক হবে বলে আশা করা যায়। আলম শাইন বন্যপ্রাণী বিশারদ alamshine@gmail.com
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১