ইউরোপজুড়ে চলছে তীব্র তাপদাহ। চুলার মতো জ্বলছে মহাদেশটির বেশিরভাগ দেশ। শুধু ইউরোপ নয়, এবার গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা মহাদেশের তাপমাত্রাও নিকট অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। বাংলাদেশও মাঝারি তাপপ্রবাহের কবলে ছিল বেশ কয়েকদিন। রাজধানী ঢাকা সম্প্রতি মুখোমুখি হয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার। এই গরম থেকে একটু স্বস্তি পেতে মানুষ ভিড় করছে নদী, সাগর, হ্রদসহ বিভিন্ন ধরনের জলাধারে। কিন্তু নতুন এক গবেষণা বলছে, কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীর অবস্থা যা হবে, তাতে সাঁতার কাটার জন্য হয়তো আর নদী বা হ্রদ খুঁজতে হবে না। সেই সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা বেড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ৬০ মিটার বা ১৯৭ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাতে বিপুল জলরাশি হয়তো চলে আসবে ঘরের দুয়ারে; কোনো কোনো দেশ তলিয়ে যাবে সাগরে।
গবেষকরা বলছেন, কার্বন নিঃসরণের হার চলতি শতাব্দীর মধ্যে কমিয়ে আনা সম্ভব না হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়বে। তাতে করে পৃথিবী প্রায় ১২ লাখ বছর আগের এক অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে। গবেষকরা ওই অবস্থাকে ‘হটহাউজ আর্থ’ নামে ডাকেন। তখন পৃথিবীর তাপমাত্রা আঠারো শতকের শিল্পবিপ্লবের সময়ের তুলনায় ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। মেরু অঞ্চলে জমাট বরফ গলতে শুরু করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ১০ থেকে ৬০ মিটার পর্যন্ত। তাতে করে পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই বাস্তুচ্যুত হবে। দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি অনেক উপকূলীয় দেশের মতো তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশও।
বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত চরম ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১০ম অবস্থানে রয়েছে। ‘গ্রাউন্ডওয়েল : প্রিপেয়ারিং ফর ইন্টারনাল ক্লাইমেট মাইগ্রেশন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নগাদ বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা হবে কমপক্ষে এক কোটি ৩৩ লাখ। কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এই সংখ্যা হবে প্রায় দ্বিগুণ।
জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) জানিয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। সে হিসাবে ‘হটহাউজ আর্থ’ অবস্থায় সমুদ্রেপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০ মিটার বাড়লেও দেশের বেশিরভাগ অংশ তলিয়ে যেতে পারে বঙ্গোপসাগরে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ভূমির উচ্চতা গড়ে মাত্র এক মিটার। ভূমিক্ষয়ের কারণে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে পলি জমে এক দিকে যেমন সাগরের গভীরতা কমছে অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পানি বাড়ছে। এ কারণে আমাদের দেশের অনেক নিচু এলাকা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
নতুন এই গবেষণাটির গবেষকদের মতোই তিনি বলেন, ‘হটহাউজ আর্থ’ অবস্থা আসলে প্রকৃতিকে দীর্ঘদিন ধরে আমরা যা দিয়েছি তারই ফলাবর্তন। প্রকৃতি তখন উল্টো আচরণ করতে শুরু করবে। এখন যেমন নদীর পানি সাগরে যাচ্ছে ওই অবস্থা হলে সাগরের পানি আসবে উজানে। মিঠা পানির সব উৎসই লবণাক্ত হয়ে যাবে। তখন কেবল খাবার পানির অভাবেই বাস্তুভিটা ছাড়তে হবে অসংখ্য মানুষকে। এ ছাড়া লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে নিচু এলাকার লাখো হেক্টর চাষযোগ্য জমি। বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে শস্য ক্যালেন্ডারেও।
রিজওয়ানা হাসান সতর্ক করে বলেন, নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। জীবাস্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে। কার্বন নিঃসরণকারী যন্ত্রের ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে থেকেই কমাতে হবে।
তিনি মনে করেন, কার্বন নিঃসরণের হার কমানো না গেলে উষ্ণায়ন ঠেকানো যাবে না। এখনই যদি বনায়নে গুরুত্ব না দেওয়া হয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জোর দেওয়া না হয়- তাহলে পরিণাম হবে ভয়াবহ। ঋতুচক্রে বিপর্যয় ঘটবে। প্রকৃতি চরমভাবাপন্ন হয়ে ত্বরান্বিত করবে ‘হটহাউজ আর্থ’ অবস্থাকে।
এ দিকে সাউথ এশিয়ানস হটস্পটস’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা না গেলে ২০৫০ সাল নাগাদ ক্ষতির মুখে পড়তে হবে দক্ষিণ এশিয়ার ছয় দেশের ৮০ কোটি মানুষকে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, নোয়াখালী, ফেনী ও খাগড়াছড়ি ছাড়াও বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলা এবং খুলনা বিভাগের বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ওইসব এলাকার মানুষ চরমভাবে বাস্তুচ্যুতের মুখোমুখি হবে।
তবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত মনে করেন, বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি অনেকটা এগিয়েছে। বাংলাদেশ ২০০৯ সালে ক্লাইমেট চেইঞ্জ স্ট্রাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে। উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলোর উচ্চতা বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ৩০ বছর বা ১০০ বছর পরে কী হবে, এর কোনো নির্দিষ্ট ধারা নেই। গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা কিছু অ্যাজাম্পশনের ভিত্তিতে অনেক কথা বলেন। সেসব কথায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশের অবস্থান অভিন্ন। পৃথিবীর সব দেশেরই এ ঝুঁকি রয়েছে। সব দেশের যে পরিণতি বাংলাদেশেরও তাই হবে।
তবে প্রসিডিং অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত নতুন ওই গবেষণার গবেষকদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আগের যেকোনো গবেষণার চেয়ে তাদেরটি বেশি যৌক্তিক। স্টোকহোম রিসাইলেন্স সেন্টারের করা ওই গবেষণার প্রধান গবেষক ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইউল স্টিফেন বলেন, আসলে কার্বন নিঃসরণই উষ্ণায়ন বাড়ার একমাত্র কারণ নয়। পৃথিবীর নিজস্ব সিস্টেমও এজন্য কিছুটা দায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনোভাবে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে প্রকৃতি ও প্রতিবেশ উল্টো আচরণ শুরু করতে পারে। তিনি জানান, ‘হটহাউজ আর্থ’ অবস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কয়েকবার ঘটেছে। প্রথম দেখা যায় প্রায় ১০ কোটি বছর আগে। আর সর্বশেষ ১২ লাখ বছর আগে। তবে শিল্প বিপ্লবের পর প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তনের গতি অনেকটাই বেড়েছে। সেই সময় থেকে প্রতিবছর গড়ে দশমিক ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা।
ইউল স্টিফেন বলেন, শুধু কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আসন্ন এই ‘মহাপ্রলয়’ থামানো যাবে না। শিল্প, কৃষি, গৃহস্থালিসহ সব ক্ষেত্রেই ইকো সিস্টেমের সঙ্গে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। নইলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে।





