পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ বাহিনীর আক্রমণ ‘৭১-এর ডিসেম্বরে তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় পাকিস্তানি হানাদারদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য একটি ভিন্ন কৌশল নেয় মিত্রবাহিনী।
পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সেনা, নৌ ও বিমান আক্রমণের পাশাপাশি ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল এসএইচএফ মানেকশ যুদ্ধে শত্রুর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ শুরু করেন। তিনি ৮ ডিসেম্বর থেকেই বেতারে পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দেশ দিতে থাকেন। বেতার ভাষণে তিনি পাকবাহিনীর নাজুক অবস্থা তুলে ধরে বলেন, তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। অতএব, আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর নেই।
আত্মসমর্পণের জন্য তিনদিন সময় বেঁধে দেওয়ার পর ঘোষণায় বার বার বলা হয়, ‘এই সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে মৃত্যু অনিবার্য। ‘হয় সারেন্ডার না হয় মৃত্যু’ এ রকমই ছিল ঘোষণা।
মানেকশের এই কৌশল পরবর্তী সময়ে পাকবাহিনীর মনোবল ভাঙতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল বলে অনেকে মনে করেন।
একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর চাঁদপুর মিত্রবাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার পরই নিয়াজীর মনোবল ভেঙে যায় এবং যুদ্ধে তিনি পরাজিত হবেন বলে প্রায় নিশ্চিত হন। এ ব্যাপারে নিয়াজী তার ‘দ্য বিট্রেয়ার অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইতে লিখেছেন বিরুদ্ধ প্রপাগান্ডা এবং ইয়াহিয়া সরকারের ত্রুটিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতির কারণে পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।’ সম্ভবত এরপর থেকেই পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে।
এই ব্যাপারে সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল কে এম শফিউল্লাও একমত ছিলেন। তিনি মনে করেন, জেনারেল এসএইচএফ মানেকশের এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ঘোষণায় যুদ্ধে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। এতে পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে যেতে থাকে। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা উজ্জীবিত হন। অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয় এবং একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর এই সুসজ্জিত আধুনিক সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর আগে হেডকোয়ার্টার থেকে ১৪, ১৫ এবং ১৬ তারিখ পাকবাহিনীর প্রতি গুলি না করার নির্দেশ আসে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আক্রমণ বন্ধ রাখা হয়।
বিশিষ্ট গবেষক মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান তার ‘মুজিবনগর সরকার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থেও এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, জেনারেল এসএইচএফ মানেকশর এই কৌশল পাকবাহিনীর মনোবল ভাঙতে সহায়ক হয়। পাকবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও তা তেমন সফল হয়নি। ভারতীয় জেনারেল জ্যাকব বিভিন্ন মাধ্যমে এ সময় নিয়াজীকে আত্মসমর্পণে রাজি করাতে চেষ্টা করেন। ঢাকায় অবস্থিত জাতিসংঘ প্রতিনিধি মার্ক হেনরী ও জন কেলিও এ ব্যাপারে তৎপরতা চালান। জ্যাকব সরাসরি পাকবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এসব কর্মকর্তা তখন সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা দাবি করে।
জবাবে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী বন্দিদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়। এরপরেই আত্মসমর্পণের খসড়া দলিল লেখার কাজ শুরু হয়। লেখা শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে এটি প্রেরিত হয়।